আবেগীয় বন্ধনে কেটে যাক অন্ধকার

১.
ছেলে যত বড় হচ্ছে, ততই যেন বাবার শঙ্কা বাড়ছে। কারণ, বিভিন্ন বিষয়ে ছেলে নিজের যে মতামত দিচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক মানুষের আচার, রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পাচ্ছে। কখনো উগ্রবাদী মতও প্রকাশ করছে ছেলে। জিজ্ঞেস করলে বলে, বাড়ির এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি তাকে ওই বিষয়ে এ রকম নেতিবাচক ধারণা দিয়েছেন।

২.
কিছুদিন আগে কলেজের প্রিন্সিপাল ফোন দিয়ে মাকে জানিয়েছেন, প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া কিছু ছাত্রকে র‌্যাগ দেওয়ার নামে মারধর করেছে তাঁর ছেলে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছেলে নির্বিকারভাবে উত্তর দিয়েছে, ‘মা, ওরা তো বাঙালি না, অন্য জনগোষ্ঠী!’ শুনে মা তো হতভম্ব।
ওপরের দুই ছেলের মতো আরও অনেকের মধ্যেই এ বয়সে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা বা লিঙ্গবৈষম্যের মতো বিষাক্ত বিষয়গুলো শিকড় ছড়াতে শুরু করে। এ থেকেই পরবর্তী সময়ে জন্ম নেয় অসহিষ্ণুতা ও উগ্রবাদ। এসব তৈরিতে আবার কখনো কখনো চেনাজানা কোনো ব্যক্তিই ভূমিকা রাখেন। সহিংস উগ্রবাদের শুরুতেই থাকে মতামত বা আদর্শগত ভিন্নতা নিয়ে ভুল ধারণা, ধোঁয়াশা। এই ধোঁয়াশা কাটিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার।

স্পষ্ট ধারণার শুরু এখানেই
পরিবারের বড়রা, বিশেষত মা-বাবা যদি ছোটবেলা থেকেই সাম্যের চর্চা করতে শেখান, তবে মানুষের ভিন্নতাগুলোও সন্তানদের চোখে সহজাত মনে হবে। সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়টিতেই তাকে বলুন অন্য মতবাদ, অন্য আদর্শের সঙ্গে একমত হওয়া জরুরি নয়, তবে ভিন্নমতের প্রতি যেন থাকে তার শ্রদ্ধা। বৈচিত্র্য আছে বলেই যে পৃথিবী সুন্দর, তা আপনার সন্তান জানুক পরিবার থেকে।

বন্ধন হোক আরও দৃঢ়
সহিংস উগ্রবাদ নিয়ে গবেষণারত সুইডিশ বিশেষজ্ঞ ম্যাগনাস র‌্যানস্টর্প মনে করেন, উগ্রবাদ একধরনের চূড়ান্ত বিধ্বংসী ক্যালাডাইস্কোপ, আর ‘পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া’, ‘অস্তিত্বের সংকট’ এর অন্যতম। পরিবারে বঞ্চনার শিকার হলে সন্তান বিপথে চলে যেতে পারে। কারণ, হতাশাগ্রস্ত মানুষকে সহজেই সহিংস উগ্রবাদের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। পরিবারের আবেগীয় বন্ধনগুলো তারা বুঝতে পারে না। তাই আমরা সবাই যে যার জায়গা থেকে যেন চেষ্টা করি পরিবারে আরও একটু সময় দিতে। কেননা, একসঙ্গে সময় কাটানোর এ অভ্যাসই হয়তো আপনার সন্তানকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বা অস্তিস্ত্বের সংকটের মতো ভয়ংকর বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে।

চর্চা হোক যুক্তির
যা চাইছে তা দিয়ে দেওয়া মানেই সন্তানকে ভালোবাসা নয়, এটা বুঝতে হবে মা–বাবাকে। এ ধরনের পরিবেশে বড় হওয়া সন্তানেরা অনেক সময় নিজের দাবি বা চাহিদা মেটাতে অপরাধে জড়িয়ে পড়তেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অভিভাবকত্ব এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এ ব্যাপারে সেভ দ্য চিল্ড্রেনস ইন বাংলাদেশের চাইল্ড প্রটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইট গভর্নেন্স–বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, সন্তানকে “না” বলে দিয়ে কোনো কিছু আসলে থামানো যায় না। যখন সে ভুল বা ক্ষতিকর কিছু করতে যাচ্ছে, তাকে এর খারাপ দিকগুলো বলুন, জানান যে এ ছাড়া কিন্তু আরও চারটি অপশন আছে। অর্থাৎ তাকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করুন, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না।’

নিশ্চিত করুন পারিবারিক সম্প্রীতি
উপমহাদেশের পরিবারগুলোতে শাসন মানে অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন। অথচ এ ধরনের আচরণের ফলে সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না, ভবিষ্যতে তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে। এ ছাড়া পরিবারের মানুষের মধ্যে ঝগড়া-হিংসা-বিদ্বেষ দেখে বড় হওয়া শিশুরা এসবকেই সহজাত হিসেবে গ্রহণ করে। অনেক পরিবারেই নারীর দুর্বল ভূমিকা থেকে সন্তানেরা শেখে নারীকে অপমান করার সংস্কৃতি, যা পরবর্তী সময়ে ইভ টিজিং থেকে শুরু করে গুরুতর সহিংস ঘটনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন মেহেজাবিন হক বলেন, ‘ছোটবেলায় যখন তার সামনে বাবা মাকে মারছে কিংবা মা তাকে মারছে, এ বিষয়গুলো মনে প্রভাব পড়ে, অবচেতনভাবেই সে-ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একই আচরণ করে। সেটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়, নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে না।’

আলোচনায় কেটে যাক ভ্রান্তি
পরিবার থেকে উদারতার শিক্ষা পাওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় বন্ধুদের চাপে বা ‘পিয়ার প্রেশার’-এ সন্তানেরা এমন কিছু করে বসে, যা উগ্রবাদী আচরণ। তাই বাড়িতেই সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলুন, জানুন তার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনগুলো। এ সম্পর্কে মেহেজাবিন হক বলেন, মা–বাবার সঙ্গে সব কিছু যেন সে শেয়ার করে, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এমনকি সন্তান যদি কোনো সহিংস আচরণে জড়িয়েও যায়, তা আড়াল করার চেষ্টা করবেন না। বরং তাকে তার ভুলটি বুঝিয়ে বলুন, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং ইউনিট বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিন।
যে বয়সে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, সে সময় তার সবচেয়ে বড় আশ্রয় পরিবার। নেতিবাচক আবেগ বশে এনে ইতিবাচক আবেগের বিকাশ ঘটানোর চর্চা তাই পরিবার থেকেই শুরু হয়। শুধু তা–ই নয়, ভুলপথে এগিয়ে গেলেও ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকেন পরিবারের লোকজনই। প্রতিটি পরিবার হয়ে উঠুক উদারতার প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র আর নির্ভরতার আশ্রয়।