ঢাকাই জামদানির রঙিন ভুবন

জামদানির নকশা। ছবি: ওয়াহেদ আশরাফ
জামদানির নকশা। ছবি: ওয়াহেদ আশরাফ

মাধবী, মালঞ্চ, মালা বা জুঁই ফুল, তেরছি, হাজারবুটি, ছিডা—কত–কী নামের বাহার! পাড় আর জমিনে সুতার চোখজুড়ানো কারুকাজ। দেখলেই মন ভরে যায়। এই হলো শাড়িপ্রেমী কন্যা-জায়া-জননীর অতি আদরের জামদানি।

ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যার পূর্ব তীরের নোয়াপাড়া, রূপসী, মৈকুলী, খাদুন, পবনকুল, মুরগাকুল, বরাব—এসব গ্রামের তাঁতিদের হাতে তৈরি হয় জামদানি। বিজ্ঞজনেরা যাকে মসলিনের উত্তরসূরি বলে থাকেন। জামদানির আভিজাত্য নকশায়। জিটল আর সূক্ষ্ম কারুকাজে সমৃদ্ধ এই নকশা। কারুকাজ আর নকশায় যে জামদানি চটকদার, তার কদরও তত বেশি।

শীতলক্ষ্যা তীরের রূপগঞ্জ আর নোয়াপাড়া জামদানির মূল কেন্দ্র। ধারণা করা হয়, আগে এটি সোনারগাঁয়ের অংশ ছিল। ফরিদপুর ও ভৈরবের কিছু গ্রামে জামদানি বয়নের কাজ শুরু হয়েছে গত এক দশকে। একসময় ধামরাই এবং ঢাকা শহরেও জামদানি তৈরি হতো বলে জানা যায় বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ১৯০৭-০৮ সালের জরিপবিষয়ক প্রতিবেদনে।

জামদানির সঙ্গে নবাবের গল্প শোনার আগে চলুন জামদানি বস্ত্রের নকশা নিয়ে কিছু কথা।

জামদানি শাড়ি।
জামদানি শাড়ি।

জামদানি নকশার উৎস
জামদানি বস্ত্রের বিচিত্র নকশার উৎস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও মতে, জামদানির নকশায় ইরান, ইরাক ও তুর্কি কার্পেট ও লৌকিক নকশার প্রভাব রয়েছে। এর সপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, মুঘল সম্রাটেরা সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ফারসির অনুরাগী ছিলেন। বিভিন্ন সময় অনেক ইরানি চারু ও কারুশিল্পীকে তাঁরা ভারতে এনেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বিভিন্ন সময় ফারসি সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেই সূত্রে ইরানি, ইরাকি বা তুর্কি নকশা জামদানির প্রচলন হয়ে থাকতে পারে।

কারও কারও মতে, জামদানির নকশা একান্তভাবে বাংলার তাঁতিদের সৃজনশীলতা পরিচায়ক। কারণ হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেন, জামদানির নকশায় রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবজগৎ ও বৃক্ষলতাযুক্ত নকশার প্রাধান্য। তাঁদের ভাষ্য, একজন জামদানি–তাঁতি বস্ত্র বয়ন করতে গিয়ে চারপাশে যে দৃশ্য দেখেছেন, তা–ই উঠে এসেছে তাঁর নকশায়। আবার বিশেষত চাকমা জনগোষ্ঠীর নকশার সঙ্গে অনেকেই জামদানির নকশার সাদৃশ্য পেয়েছেন। এসব মতবাদ লক্ষ করে ‘জামদানী’ গ্রন্থের লেখক, বিশিষ্ট লোকগবেষক মোহাম্মদ সাইদুর জানাচ্ছেন, ‘...দেশকালগতভাবে একক কোনো প্রভাব থেকে জামদানি নকশার উদ্ভব হয়নি, বরং এতে কালে কালে এসে মিশেছে বিভিন্ন উপজাতীয় প্রভাব, হিন্দু-বৌদ্ধ প্রভাব, মুসলিম প্রভাব, ব্রিটিশ প্রভাব, পাকিস্তানি ও বর্তমানে বাংলাদেশি প্রভাব। সুতরাং এটি বিভিন্ন প্রভাবের একটি মিশ্রিত রূপ আর লৌকিক ধারানুযায়ী এসব প্রভাব মিলেমিশে একাকার হয়ে জন্ম নিয়েছে ঐতিহ্যবাহী জামদানি নকশার।’ উল্লেখ্য, সুলতানি ও মুঘল আমলে এই শিল্প বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে। এ কারণে এর মধ্যে পারস্য প্রভাব থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে কালের বিবর্তনে সেসব নকশার স্থানীয়করণও ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বলা বাহুল্য, এই প্রক্রিয়া এক দিনে ঘটেনি। একটা দীর্ঘকালীন রূপান্তর প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জামদানির নকশা একুশ শতকে উপস্থিত হয়েছে।

নকশার একাল–সেকাল
জামদানির নকশার কথা বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাড়ির পাড়ভর্তি রঙিন ফুল আর জ্যামিতিক ছাঁচ; জমিনের টানা ও পোড়েনের সুতায় রঙিন বুটি আর ছিডার জাল বা তেরছি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো জামদানির নকশার ইতিহাসে এই ‘রঙিন নকশা’ মাত্র শখানেক বছরের গল্প। যেহেতু গবেষকেরা মনে করেন, জামদানি হচ্ছে মসলিনের ‘অপভ্রংশ’ রূপ, আর মসলিন ছিল টানাপোড়েনে সাদা সুতায় তৈরি। তাই ধারণা করা যায়, জামদানির আদি নকশা সাদা সুতার ওপরে সাদা সুতা দিয়ে করা হতো। তবে খুব অল্প পরিমাণ রঙিন সুতা যে ব্যবহৃত হতো না, সেটা বলা যায় না।

জামদানি বস্ত্রের নকশার এই বিবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাকিম হাবিবুর রহমানের (১৮৮১-১৯৪৭) নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি বলছেন, ‘আমাদের বাল্যকাল পর্যন্ত জামদানির উত্তম ধরনসমূহের মধ্যে “আশরাফি বুটি”, “মাছিবুটি”, “জালিদার এবং লহরিয়া” নামের সাদা রঙের জামদানি তৈরি হতো এবং এটিই হচ্ছে প্রাচীন ধারা।’ অবশ্য হাকিম হাবিবুর রহমান এও বলছেন, শাড়ির পাড়ে কালো ও লাল বুটির প্রচলন তাঁর বাল্যকালেই শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি বলছেন,‘আজ থেকে ৫০ বছর আগে পর্যন্ত জামদানি শুধু সাদাই তৈরি হতো, অবশ্য শাড়ির হাসিয়ায় লাল–কালো (সুতার) কাজ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতো, জমিন সাদা থাকত এবং এটাই ছিল আসল রীতি। আমার বাল্যকালে...ওই সময় পর্যন্ত শুধু সাদা জমিনের জামদানি তৈরি হতো।’ জামদানির নকশার বিবর্তনের একই রকম তথ্য দিয়েছেন জর্জ ওয়াট ও পার্সি ব্রাউন।

জামদানিতে নকশা তোলা হচ্ছে। ছবি: ওয়াহেদ আশরাফ
জামদানিতে নকশা তোলা হচ্ছে। ছবি: ওয়াহেদ আশরাফ

এরপর জামদানির নকশা আরও পরিবর্তনের পথে হাঁটতে শুরু করে। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫)। হাকিম সাহেব জানাচ্ছেন, ‘...সর্বপ্রথম তিনি বিভিন্ন ধরনের রঙের জমিনের ওপর ভিন্ন ভিন্ন রঙের বুটি ও ফুল নিজস্ব ডিজাইন এবং নকশা সহযোগে তৈরি করান এবং সর্বপ্রথম তিনিই রঙিন জামদানির ব্যবহার শুরু করেন। ফুলের মধ্যে বড় বড় উদ্ভাবন হতে থাকে এবং জীবনের শেষের দিকে দৈনন্দিন সময়ের এক বড় অংশ তাঁর এ ধরনের নকশা তৈরিতেই কেটে যেত। এই জামদানি অবশ্যই খুব দামি হয়ে গিয়েছিল। বাংলার ধনী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এটিই ব্যবহার করা শুরু করেন এবং সাদা জামদানির ব্যবহার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।’ অর্থাৎ মানে দাঁড়াচ্ছে, উনিশ শতকের শেষ দশকে কিংবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় রঙিন জামদানি তৈরি হওয়া শুরু হয় এবং ক্রমে তা জনপ্রিয় হতেও শুরু করে। জীবনসায়হ্নে এসে নবাবের নিজে নকশাকার হয়ে যাওয়ার তথ্যটি আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষকই বটে!

হাকিম হাবিবুর রহমানের সূত্র অনুযায়ী, জামদানি বস্ত্রের রঙিন নকশার গল্প শুরু হয় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর সময় থেকে। তত দিনে জামদানিতে রঙিন নকশার যুগ শুরু হয়েছে। ফুল, পাখি, লতাপাতা—সবই রঙিন।

>জামদানি সম্পর্কে ১০ তথ্য
১. একসময় নারীদের জামদানি কাপড় বুনতে দেওয়া হতো না। মনে করা হতো, মেয়েদের জামদানি বয়ন করা শেখালে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাঁরা জামদানি বুনতে শুরু করবেন। এতে ব্যবসা বেহাত হয়ে যাবে।
২. জামদানি কাপড় বোনার জন্য হাতে সুতা তৈরি করা হতো। স্থানীয় পদ্ধতিতে তৈরি সরল তাঁতযন্ত্রে এখনো হাতেই বোনা হয় জামদানি। জামদানি কাপড় তৈরির জন্য যে তাঁত ব্যবহার করা হয়, তার স্থানীয় নাম ‘পডি’।
৩. জামদানিতে নকশা তোলার জন্য মহিষের শিং দিয়ে তৈরি কাণ্ডুল ব্যবহার করা হয়; যদিও এখন প্লাস্টিকের কাণ্ডুল বাজারে পাওয়া যায়।
৪. জামদানি শাড়ির পাড়ের নকশার নামে শাড়ির নামকরণ করা হয়।
৫. জামদানি বস্ত্র বোনার জন্য যে তুলার চাষ হতো, সেই তুলার বীজ এখন আর পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, উনিশ শতকে তুলার সেই স্থানীয় প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৬. জামদানি বস্ত্র তৈরি করার জন্য একটি তাঁতে দুজন তাঁতি বসে কাজ করেন। ডান পাশে যিনি বসেন, তিনি ওস্তাদ কারিগর। বাঁ পাশে যিনি বসেন, তিনি শাগরেদ।
৭. খুব ছোটবেলা থেকে জামদানি–তাঁতিদের বস্ত্র বয়ন করতে শেখানো হয়। ধারণা করা হয়, ছোটবেলায় মানুষের হাত খুব নরম থাকে বলে তারা ভালো নকশা করতে পারে।
৮. শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র—এই তিন নদ-নদীর মধ্যবর্তী যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল, সেখানে জামদানি বস্ত্র তৈরির তুলা উৎপন্ন হতো। এই তুলা দিয়ে মসলিন বস্ত্রও তৈরি করা হতো।
৯. হাফসিল্ক ও ফুলকটন—এই দুই ধরনের জামদানি তৈরি হয়। টানায় সিল্ক সুতা এবং পোড়েনে সুতি সুতা দিয়ে হাফসিল্ক এবং টানা-পোড়েনে সুতির সুতা দিয়ে ফুলকটন জামদানি তৈরি হয়।
১০. বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে জামদানি তৈরি হয়। এর বাইরে ভৈরবের কয়েকটি গ্রামে এবং ফরিদপুরের কয়েকটি গ্রামে জামদানি শাড়ি তৈরি হয়। ‘টাঙ্গাইলা জামদানি’ নামে বাজারে যে শাড়ি বিক্রি হয়, সেগুলো জামদানি শাড়ি নয়। সেগুলোতে শুধু জামদানির নকশা তোলা হয়। কিন্তু শাড়িগুলো তৈরি হয় চিত্তরঞ্জন তাঁতে।

মূলত পাড় ও জমিন—এই দুই ভাগে জামদানির নকশাকে ভাগ করা যায়। পাড় ও জমিনের নকশার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। সাধারণত, জামদানি বস্ত্রের, বিশেষ করে শাড়ির নামকরণ করা হয় পাড়ের নামে। যেমন: কলকাপাড় শাড়ি, মালঞ্চপাড় শাড়ি ইত্যাদি। একটি জামদানি শাড়ি দৃষ্টিনন্দন করার জন্য পাড়ের নকশা প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এর নকশায় সাধারণত বিভিন্ন ধরনের লতাপাতা, ফুল, পশুপাখির আদল বয়ন করা হয়। যেকোনো পাড়ের নকশার একটি মূল মোটিফ থাকে। এই মোটিফকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি শাড়ির পাড়ের নকশা। আর একটি মোটিফের সঙ্গে থাকে একাধিক আনুষঙ্গিক ছোট নকশা। এই নকশাগুলো ছাড়া ডিজাইন সম্পন্ন হয় না।

পাড়ের নকশার পরেই জামদানির নকশার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় হচ্ছে জমিনের নকশা। জমিনের নকশার ক্ষেত্রে তিনটি আদি ধরন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাল, বুটি/ছিডা ও তেরছি। এ ছাড়া ‘ঢেউ’ আকৃতির কিছু নকশা তৈরি করা হয় জমিনে। যেকোনো নকশাকে জলের ঢেউয়ের মতো তরঙ্গায়িত করে তৈরি করলেই সেটি ‘ঢেউ’ নামে পরিচিতি পায়। সাধারণত, পাড়ের নকশা আঁচলের নকশা হিসেবে বয়ন করা হয়। পাড়, জমিন ও আঁচল—এই তিন নকশা নিয়েই জামদানির বাহার আজও বিরাজমান।

জামদানির আভিজাত্যই বলি আর অহংকারই বলি, সেটা হচ্ছে তার নকশায়। আর আর্থিক মূল্যায়নে সেটিই সবচেয়ে দামি, যেটির নকশা সবচেয়ে ঘন, সবচেয়ে ভারী এবং জটিল। এই সরল সমীকরণ আজও ভাঙেনি। নকশা যতই জটিল হোক না কেন, জামদানির তাঁতিরা নকশাগুলোর বাইরের রেখাকে তাঁদের তাঁতের বিশিষ্ট সরলরেখা ও সমকোণে প্রশংসনীয় দক্ষতায় খাপ খাইয়ে নিয়েছেন।

জামদানির কারিগরেরা তাঁদের চারদিকে যা দেখেন, তা–ই নকশার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারেন জামদানিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আশফুলপাড়, ঝুমকাপাড়, আমরের মৌরপাড়, নিশানপাড়, পুঁইলতাপাড়, সুপারি টাংকিপাড় ইত্যাদি। ‘আশফুল’ হচ্ছে মূলত দুটি রাজহাঁসের মাথার ফুলের আকৃতির নকশা (রূপগঞ্জের স্থানীয় উচ্চারণে হাঁস হয়ে গেছে আশ), ঝুমকাপাড় হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট কানের দুলের নকশার প্রতিকৃতি, আমের মৌর হচ্ছে আমের মুকুল, নিশান হচ্ছে তিনকোনা পতাকা, পুঁইলতা হচ্ছে পুঁই শাকের ডগা, সুপারি টাংকি হচ্ছে সুপারির ছড়া। এভাবে তাঁতিদের দেখা চারপাশের বিভিন্ন বিষয় এসেছে জামদানি নকশায়। এসব নকশা লাল, নীল, কালো, বেগুনি, সবুজ, সাদা ইত্যাদি রঙে রঙিন হয়ে জামদানিকে করেছে বর্ণাঢ্য ও রাজসিক।

শিল্পীর আঁকা পাড়।
শিল্পীর আঁকা পাড়।

জটিল নকশার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতাই জামদানি তাঁতিদের বিশেষ গুণ। তবে একালের জামদানি তাঁতিদের মধ্যে এই ‘ক্ষমতা’র কিছুটা খামতি রয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। এই খামতির কারণ এখন জামদানির নকশা প্রণয়নের কাজে প্রবেশ করেছে বিশাল করপোরেট পুঁজি। নগরকেন্দ্রিক ডিজাইনাররা বিভিন্ন বড় প্রতিষ্ঠানের ফরমাশে ডিজাইন করছেন জামদানির! সেসব ডিজাইন চলে যাচ্ছে একেকজন মহাজনের ‘বাংলা’তে (স্থানীয়ভাবে কারখানাকে বাংলা বলা হয়)। কারিগরেরা শুধু সেই ডিজাইন বুনে দিচ্ছেন তাঁতযন্ত্রে। আগে মতো ‘মাথা খাটিয়ে’ নতুন নতুন নকশা উদ্ভাবনের কোনো তাগিদই অনুভব করেন না কারিগরেরা। যাঁরা ঠিক মহাজনের ‘বাংলা’র সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের কাছে ‘শহুরে নকশা’ আসে না। কিন্তু তাঁরাও ‘কপি পেস্ট’ করে চলছেন। তা না হলে পুরোনো ডিজাইনই একটু এদিক–সেদিক করে চালিয়ে দিচ্ছেন। নতুন কোনো ডিজাইন তৈরি করছেন না। তবে হ্যাঁ, বড় করপোরেট হাউসগুলোর কারও কারও রয়েছে পুরোনো নকশার অনবদ্য সংগ্রহ। সেসব পুরোনো নকশা থেকেই এখনকার ডিজাইনাররা নতুন নতুন নকশা করছেন জামদানির জন্য।

এটা বলে রাখা দরকার, নতুন নতুন নকশার উদ্ভব না হলেও তাঁতি বা কারিগরেরা কিন্তু বুননের রাজসিকতা থেকে সরে আসেননি এখনো। শতভাগ হাতে বোনা জামদানির নকশা তাই এখনো রাজসিক, এখনো অভিজাত।

তথ্যসূত্র
১. হাকিম হাবিবুর রহমান, ‘ঢাকা: পঞ্চাশ বছর আগে’, অনু. ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম, প্যাপিরাস, ঢাকা, ২০০৫।
২. লালা রুখ সেলিম (সম্পা.), ‘চারু ও কারুকলা’, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
৩. মোহাম্মদ সাইদুর, ‘জামদানী’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৩।
৪. তোফায়েল আহমদ, ‘আমাদের প্রাচীন শিল্প’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯২।