মুক্তিযুদ্ধের কাছে যাওয়া

ঘর থেকেই বোনা হোক দেশপ্রেমের বীজ। ছবি: নকশা
ঘর থেকেই বোনা হোক দেশপ্রেমের বীজ। ছবি: নকশা

ব্যাপারটা এমন নয় যে আলাদিনের দৈত্য এসে মুশকিল আসান করে দেবে; আপনি বলবেন, ‘আমার মনে দেশপ্রেম জাগিয়ে দাও’ আর দৈত্য অমনি এমন কিছু কাণ্ড করে বসবে যে নিমেষেই আপনি হয়ে পড়বেন দেশপ্রেমিক, ভালোবেসে ফেলবেন দেশকে কিংবা দৈত্যের প্রেরণায় আপনি আপনার সন্তানের মনে মুহূর্তের ভোজভাজিতে দেশের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারবেন।
দেশপ্রেম এভাবে জেগে ওঠে না। আমরা বলি, স্বাধীনতার ফসলের কথা। ফসল কখন হয়? ফসল হয় জমি কর্ষণ করে বীজ বোনা হলে। এই যে জমি চাষ করা হলো, বীজ বোনা হলো, তারপরই তো হলো ফসল। এখন যদি জমি চাষ করা না হয়, বীজ না বোনা হয়, তাহলে ফসলটা আসবে কোত্থেকে? দেশপ্রেমটাও ওই ফসলের মতো ব্যাপার। প্রাণে তা জাগানোর আগে কর্ষণ আর বীজ বোনার দরকার আছে। আর সেটা শুরু হতে হয় পরিবার থেকে।

কথাবার্তা
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা হতে হবে বাড়িতেই। আপনার সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই বিজয়ের কথা বলুন। যুদ্ধের কথা বলুন। বলুন উদ্বাস্তুদের কথা। বলুন গণহত্যার কথা। মুখস্থ করার ভাষায় বলবেন না। বলবেন গল্পের মতো করে। সেই বৃদ্ধার কথা বলুন, যিনি তাঁর একমাত্র মোরগটি জবাই করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে দিয়েছিলেন। বলুন সেই কিশোরটির কথা, যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিল বলে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করেছিল তাকে। বলুন চুকনগর গণহত্যার কথা, যেখানে ২০ মে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানিরা। ছোট ছোট গল্প যে ছবি আঁকবে শিশুর মনে, তা সারা জীবন অক্ষয় হয়ে থাকবে।

ভ্রমণ
তারপর কোনো একদিন বেরিয়ে পড়ুন ভ্রমণে। আগে থেকে ঠিক করে নিন, কোথায় যাবেন। যেখানে যাচ্ছেন, জেনে নিন তার ইতিহাস। তারপর গল্পের মতো করেই বলুন সে ঘটনা। যদি গল্লামারী বধ্যভূমিতে যান, তবে সেখানকার স্মৃতিসৌধের কাছে গিয়ে একাত্তরে এখানে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের কথাই বলুন। কিংবা সন্তানকে নিয়ে যান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের কাছে। ক্র্যাক প্লাটুনের কথা বলুন, বলুন গ্রিন রোড অভিযান কিংবা মতিঝিল অভিযানের কথা। দেখবেন, আপনার সন্তান তার মনে নিজের মুক্তিযুদ্ধ এঁকে নিচ্ছে।

বই
হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইগুলো পারে শিশুমনের চাহিদা মেটাতে, সে ইতিহাস নিয়েই হোক আর গল্প–উপন্যাস–কবিতা বা ছবির বই–ই হোক না কেন। ইদানীং কমিকসের প্রতি তীব্র আকর্ষণ দেখা যাচ্ছে শিশুদের। কমিকসে সহজেই একটা ঘটনা বোঝা যায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেই খুঁজে নেবে এ বিষয়ে তাঁর প্রয়োজনীয় বইগুলো।

পোশাকে
কেউ কি খেয়াল করে দেখেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ কিংবা বিজয় দিবসে দেশীয় পোশাকের প্রতি আগ্রহ জন্মাচ্ছে সবার? একুশে সাদা–কালো, পয়লা বৈশাখে লাল–সাদা, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে লাল–সবুজের প্রতি আকর্ষণটা কি লক্ষ করা যাচ্ছে না? এভাবেও দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটছে। সন্তানেরাও আপনার সঙ্গে সঙ্গে এই ঐতিহ্যকে বরণ করে নিচ্ছে।

এখনো মুক্তিযোদ্ধা
যদি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় সন্তানকে, তাঁদের কাছ থেকে শোনা যায় সত্যিকারের যুদ্ধের গল্প, তাহলে যেকোনো শিশুই নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাবে। একেকটা ঘটনায় মূর্ত হয়ে উঠবে একটি জাতির জন্মের কথা। যুদ্ধের কথা বলার সময় সত্যিকার যোদ্ধাদের চোখে যৌবন ভর করে—এটা আমি বারবার দেখেছি।

জাদুঘর
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কিংবা যেকোনো বধ্যভূমিতে তৈরি হওয়া জাদুঘরে যদি আপনার সন্তানকে নিয়ে যান, তাহলেও নিজেদের ইতিহাসটা সে খুঁজে পাবে অবলীলায়। চোখের দেখার একটা আলাদা শক্তি আছে। আমি অনেককেই দেখেছি, জাদুঘর ঘুরে আসার পর সে একটু হলেও পরিণত হয় অন্য মানুষে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তিন বছর বয়সী একটি মেয়ের জামা রাখা আছে, যাকে পায়ে পিষে মেরেছিল পাকিস্তানি সেনারা। সে কথা শোনার পর একটি মেয়ে আধঘণ্টা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিল—আমি নিজের চোখে দেখেছি।
আর হ্যাঁ, প্রযুক্তির যুগে অন্তর্জালে ঘুরেও পাওয়া যেতে পারে অনেক কিছু। এমনকি নিজেও তো নতুন কিছু যুক্ত করতে পারে যে কেউ। নিজেদের দেশের ইতিহাস অন্তর্জালে ঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে লাভ হবে দেশের সবার।

শিক্ষকের কাছে
বাড়ির পাশাপাশি স্কুলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন যদি শিক্ষকেরা, তাহলেও শিশুদের মন হয়ে ওঠে দেশপ্রেমী। পড়ালেখা মানে তো শুধু মুখস্থ করা নয়, জীবনকে বোঝা। জীবন বোঝার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের রয়েছে বড় ভূমিকা। তাঁরা যদি জীবনের আনন্দের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে পারেন শিশুর মধ্যে, তাহলে সে হয়ে উঠবে রুচিশীল এবং ইতিহাস–সন্ধানী মানুষ। এ মানুষ চলবে যুক্তি আর দেশপ্রেম বুকে নিয়ে। এ মানুষ বিপথে যাবে না।