ঐতিহ্যের তাঁতশিল্প

প্রাচীনকাল থেকে আমাদের গর্ব করার মতো অল্প কিছু বিষয়ের একটি অবধারিতভাবেই তাঁতশিল্প। তাঁতশিল্পের গভীরে যেতে হলে যেতে হবে ইতিহাসের গভীরে। প্রাক্–ঔপনিবেশিক আমলের দিকেই রাখতে হবে চোখ। বুঝতে হবে কৃষক আর তাঁতির সম্পর্ক। আর এই পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়।

আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ঔপনিবেশিক প্রভাব এত তীব্র যে সে শিক্ষা মগজে নিয়ে তাঁতশিল্পকে বোঝা যাবে না। যখন আমরা ধারাবাহিকতাকে গুরুত্ব দেব এবং জানব যে পুঁজি আর মুনাফার কারণেই তাঁতশিল্পের কপাল পুড়েছে, তখনই বুঝতে পারব ব্রিটিশ আমলকে কেন আমরা তাঁতশিল্পের দীর্ঘশ্বাস বলে বর্ণনা করছি।

সুলতানি ও মোগল আমলে তাঁতশিল্প বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন নিজ হাতে তুলে নিল এ দেশের শাসনভার, তখন সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল। মনে রাখতে হবে, সে সময়েই ইংল্যান্ডে হলো শিল্পবিপ্লব। প্রতিষ্ঠিত হলো সুতা আর কাপড়ের মিল। ব্যস! অন্য এক মহাদেশে সংঘটিত শিল্পবিপ্লবের প্রভাব পড়ল আমাদের তাঁতশিল্পসহ জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক বিষয়ে। শুরু হলো নতুন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ।

যে যুদ্ধের কথা বলছি, সে যুদ্ধের একটি অংশ ছিল হাতে চালিত তাঁতকে ধ্বংস করার যুদ্ধ। উনিশ শতকে ভারতবর্ষে ইংরেজরা সুতা আমদানি করল, যা ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। কম দাম, তাই ব্রিটিশ সুতা ও কাপড় বাজার পেল। শিল্পবিপ্লবে কম পয়সায় ট্যাক্সবিহীন কাপড় আমদানি আমাদের তাঁতিদের জীবনে নিয়ে এল অমাবস্যা।

শাওন আকন্দ প্রথম যখন বইটি লেখার কথা ভাবলেন, তখন বোঝেননি তাঁতের কাহিনিটি জানার জন্য পাড়ি দিতে হবে ইতিহাসের দীর্ঘ পথ। শুধু তা–ই নয়, চারুকলায় শেখা ট্যাপিস্ট্রিও তাঁতের মর্মমূলে প্রবেশের জন্য খুব বেশি আগুয়ান কিছু ছিল না। সুতা কী, রং কী, তাঁতি ব্যাপারটাই–বা কী—এসব জানতে বুঝতে এবং এ নিয়ে লিখতে কেটে গেল সাড়ে তিন বছর। এ যেন নতুন এক নেশা। নেশা ছাড়া এ রকম একটি বই কারও পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। বইটিতে রয়েছে পরিশিষ্টসহ ১২টি অধ্যায়, শাওন যাকে বলছেন পর্ব। তাঁতশিল্পের উদ্ভব, বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সোনালি অতীত, সুতা, রং, তাঁতযন্ত্রের বিবর্তন, তাঁতিদের কথা, বয়নপদ্ধতি, নকশা, বাজার–বিক্রয়–বিপণনের পর রয়েছে এই শিল্পসংশ্লিষ্ট অনেকগুলো সাক্ষাৎকার। এরপর পরিবর্তনের রূপরেখার ওপর আছে আলোকপাত।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তোড়ে দেশজ সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছিল। তারই পথ ধরে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সংস্কৃতিজগতে বড় বড় ঘটনা ঘটতে থাকে। তার একটি হলো ছায়ানটের বর্ষবরণ, তাতে লাল পাড়ের সাদা শাড়ির প্রচলন হলো। সত্তর দশকে মসলিন, জামদানির প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হলো। আশির দশকে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের প্রতিষ্ঠাও এই শিল্পের প্রতি আগ্রহের আরও একটি সোপান বলে মনে করা যায়। এরপর তাঁতের অগ্রযাত্রা দেখার মতো। একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে এখন, কিন্তু মনে করার কোনো কারণ নেই, বাজার অর্থনীতিতে এই শিল্প খুব দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, বরং উল্টো, পায়ের নিচের পাটাতনটা এখনো টলোমলো। কিন্তু এই শিল্প টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

শাওন আকন্দের বইটি অনেক বড় গবেষণার ফসল। এই ফসল ঘরে তুলতে হয় অনেক যত্ন করে, মমত্ব দিয়ে বিষয়টি ধারণ করে, নইলে তা টিকবে না।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প

শাওন আকন্দ

প্রচ্ছদ: ইশরাত জাহান

প্রকাশক: দেশাল, ঢাকা

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮

৪৩৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২৪০০ টাকা।