মাছে-ভাতে বাঙালি

তখনো তিনি ‘ওস্তাদ’ হয়ে ওঠেননি। কিন্তু রামপুর দরবারে তত দিনে চার বছর সরোদ বাজানো শিখে ফেলেছেন। বাজানো দেখে বন্ধুরা হিংসায় জ্বলেপুড়ে শেষ! আলাউদ্দীন খাঁর হাতের সরোদ, এসরাজ, বীণা তত দিনে অনুরণন তুলে জানান দিচ্ছে, একদিন তিনি শাসন করবেন ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা। অবাঙালি বন্ধুরা তাঁকে তাচ্ছিল্য করত, ‘মচ্ছিকে পানি পিনেওয়ালা’ বলে। দু-চার মাস তিনি সব সহ্য করলেন। তারপর একদিন ভীষণ খেপে গিয়ে সতীর্থ জমিরুদ্দীনকে বললেন, ‘পায়ে ধরে সরোদ বাজাব। শুনবি?...বাঁ হাতে বাজিয়ে শোনাব।’ সেই থেকে তিনি বাঁ হাতে তারের যন্ত্র আর ডান হাতে চামড়ার যন্ত্র বাজাতেন। বাঙালি আর মাছের কথা উঠলে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর এই গল্প মনে পড়ে। মনে পড়ে, কী ভীষণ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এক ‘মাছখোর’ বাঙাল বাঁ হাতে সরোদ বাজিয়ে জয় করেছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের ভুবন।

পুরোনো বইপত্র, প্রত্ননিদর্শন—সবকিছুতেই মোটাদাগে যা দেখে বাঙালি চেনা যায়, তা হলো তার ভাত ও মাছ খাবার অভ্যাস। কৃষিজাত শস্যের মধ্যে ধান এখনকার মতো অতীতেও ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্যশস্য। রূপশালী, বাঁশীরাজ, অঞ্জনা, কৃষ্ণচূড়া, পদ্মশাল, রাজাশাইল, দুধকলম, সুন্দরমুখী, আন্ধারমানিক—কতশত নামের কত কত ধান যে সুঘ্রাণ ছড়াত প্রাচীন বাংলার বুকে, তার কোনো লেখাজোখা নেই। বলা হয়ে থাকে, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে এক লাখের বেশি প্রজাতির ধান ছিল একসময়।

এ পর্যন্ত সবচেয়ে পুরোনো ধানের ফসিল পাওয়া গেছে চীনের উত্তর জুয়ানঝি অঞ্চলের দায়াতনঘুয়ান গুহায়—যার আনুমানিক বয়স প্রায় ১০ হাজার বছর। তবে সেই ধানের নমুনাগুলো বন্য নাকি আধুনিক কালের ‘পোষ মানা’, তা নিয়ে বিস্তর মতবিরোধ আছে। এই আবিষ্কারের সূত্র ধরে বলা যায় যে আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগের মানুষ ধানের ব্যবহার জানত। ভারতের উত্তর প্রদেশের লহুরাদেওয়ার নিকটবর্তী জলাশয়ের তলদেশে মিলেছে কমপক্ষে সাত হাজার বছরের পুরোনো বুনো ধানের খোঁজ। চীন দেশ থেকেই হোক আর ভারত থেকেই হোক—ধান ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সুদীর্ঘকাল ধরে এই বিশাল অঞ্চলে এটি প্রধান খাবার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রাচীন বাংলায় খাদ্যশস্য হিসেবে ধানের প্রচলনের উদাহরণ পাওয়া যায় প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে, মৌর্য শাসনের কালে করতোয়া নদীর তীরে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে মানুষের যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজকীয় শস্যভান্ডার থেকে দুস্থ জনসাধারণকে ঋণ হিসেবে ধান বিতরণ করার এক রাজ ফরমান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, কোনো মৌর্য শাসক শিলালিপির মাধ্যমে এই ফরমান জারি করেছিলেন।
ধানের অস্তিত্ব যেহেতু ছিলই আমাদের এই ভূখণ্ডে, ভাত খাওয়ার প্রচলনও ছিল স্বাভাবিকভাবে। আনুমানিক পনেরো শতকে লিখিত কাব্য প্রাকৃতপৈঙ্গল থেকে এই অঞ্চলের মানুষের খাবার সম্পর্কে জানা যায়, ফেনা ওঠা ভাত, যা খাওয়া হতো কলাপাতায়, তাতে থাকত গাওয়া ঘি, পাটশাক, ময়না/মৌরালা মাছ আর সঙ্গে দুধ। প্রাকৃতপৈঙ্গল ছাড়াও বৃহদ্ধর্মপুরাণ, ভবদেব ভট্ট রচিত প্রায়শ্চিত্তকরণ, শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত ইত্যাদি প্রাচীন গ্রন্থে বাঙালির ভাত খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই ভাতের সঙ্গে যা খাওয়া হতো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাছ।

নীহার রঞ্জন রায় বলেছেন যে বৃষ্টি ও নদী-খাল-বিল বহুল, প্রশান্ত সভ্যতা প্রভাবিত এবং আদি-অস্ট্রেলীয় মূল বাংলায় খুব স্বাভাবিক কারণে মাছ অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। হেনরি লুইস মর্গান তাঁর আদিম সমাজ বইয়ে বলেছেন, মানুষের উত্তরণের সূচনা হয় মূলত মাছ খাওয়াকে কেন্দ্র করে। তিনি ধারণা করেছেন, মাছ খাওয়াকে কেন্দ্র করেই মানুষ আগুনের আবিষ্কার করেছে। ভারতবর্ষে পাওয়া মাছের ফসিলের বয়স ৩০ কোটি বছরের পুরোনো! আরও একটি মাছের ফসিল পাওয়া যায় ভারতে, তার বয়স ১৮ কোটি বছর। বেলুচিস্তানের বোলান গিরিপথের ধারে পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন যে কৃষিপ্রধান নগরের সন্ধান পাওয়া যায়, তার নাম মেহরগড়। সাত হাজার থেকে দুই হাজার তিন শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সেখানে গড়ে উঠেছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। এই প্রাচীন সভ্যতার সুলুক সন্ধানের জন্য নৃতাত্ত্বিক খননের সময় পাঁচটি মাছের ছবি আঁকা একটি পোড়ামাটির থালা পাওয়া যায়। দুই হাজার সাত শ থেকে দুই হাজার পাঁচ শ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কোনো এক সময় এই থালাটি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। মাছের ছবি আঁকা এই থালা প্রমাণ করে যে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় মাছ ছিল জনপ্রিয় খাবার। এসব নৃতাত্ত্বিক প্রমাণের সূত্র ধরে ধারণা করা অসংগত নয় যে সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের মানুষ মাছ ও ভাত খায় এবং নদীমাতৃক প্রাচীন বাংলায়ও মাছ-ভাত খাওয়ার অভ্যাস অত্যন্ত প্রাচীন।

মাছ ও ভাতের এই রাজযোটক তৈরি হলো কীভাবে, তার কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায় যে ধান এবং মাছ অনায়াসে জন্মাত এই বাংলায়, এখনো যেমন জন্মায়। খাদ্য উপাদানের সহজলভ্যতা কোনো অঞ্চলের খাদ্যসংস্কৃতির মূল ভিত তৈরি করে। যে অঞ্চলে খাবারের যে উপাদান সহজলভ্য, সে অঞ্চলে সে উপাদানকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সেই অঞ্চলের প্রধান খাদ্যের পরম্পরা। সহজলভ্যতার কারণে ধান ও মাছ কালক্রমে বাঙালির প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে। সে কারণে দেখা যায়, শুধু খাদ্যে হিসেবেই নয়, বাঙালির যাপিত জীবনের বিভিন্ন মাঙ্গলিক বাতাবরণেও ধান ও মাছের উপস্থিতি রয়েছে বিস্তর। বাঙালির সামাজিক মনস্তত্ত্বে তাই, ধান মানেই ধন আর মাছ মানেই (নারীর ক্ষেত্রে) উর্বরতা।
ধান ও মাছ থেকে কত রকমের খাবার তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে বাঙালির রয়েছে লোকায়ত জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। সমাজের সব স্তরের মানুষই ভাতের সঙ্গে মাছ খেত এবং এখনো খায়। মূলত ভাতের সঙ্গে মাছ এবং বিভিন্ন প্রকারের শাকই বাঙালির আদি খাবার। প্রতিদিনের খাবারের পাতে যেমন, উৎসবেও তেমনি মাছ ও ভাত ছিল বাঙালির প্রধান খাবার। বেহুলার বিয়েতে ঝোল-ঝাল-ভাজাসহ রান্না হয়েছিল ১৮ পদের মাছ! আর পনেরো শতকের শেষের দিকে কবি বিজয় গুপ্ত কিংবা ষোলো শতকে রচিত দ্বিজবংশীদাসের মনসামঙ্গলের পাতায় পাতায় মাছের ছড়াছড়ি। এই দুই কবিই যথাক্রমে বরিশাল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। রুই, বোয়াল, খলসে, ভাংরা, রিঠা, চিংড়ি, ইলিশ, মাগুর, শিং, মৌরালা, শোল—কোন মাছের কথা উল্লেখ করেননি তাঁরা? একদিকে বিজয় গুপ্ত বলছেন,
‘[…] মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ।
ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ।।
ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সুতা।
তেলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা।। […]’
অন্যদিকে দ্বিজবংশীদাস বলছেন,
‘[…] পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল।
পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল।। […]’
বাঙালির ভাত ও মাছ খাওয়ার রয়েছে এক সুদীর্ঘ পরম্পরা এবং রসায়ন। এই রসায়ন গড়ে উঠেছিল ভূপ্রকৃতি, কৃষিকেন্দ্রিকতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির নিরিখে। সুফলা মাটিতে ধান আর টলটলে জলের পুকুরে বা নদীতে মাছ—এই বাস্তবতায় যে জীবনযাপনপ্রক্রিয়া বাঙালি তৈরি করেছিল শত শত বছর ধরে, তাতে সুখ ও সমৃদ্ধির নানা সংস্কার-বিশ্বাসে, মাঙ্গলিক চিন্তায় ধান আর মাছ সমানভাবে উপস্থিত। প্রতিদিনের হেঁশেল থেকে উৎসবের ভোজে তো বটেই, সন্তানসন্ততি আর ঐহিক মঙ্গল কামনায় বাঙালি ধান আর মাছের কাছেই ফিরে গেছে যুগে যুগে। তারপরও ঈশ্বরী পাটুনি কেন সন্তানদের মাছে ভাতে রাখতে না চেয়ে ‘দুধে ভাতে’ রাখতে চেয়েছিলেন, সেটা এক রহস্যই বটে। পাটুনি না বললেও গুপ্ত কবি ঈশ্বরচন্দ্র বাঙালির সারসত্য প্রকাশ করেছেন:
‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’

তথ্যসূত্র:
১. সনৎ কুমার মিত্র (সম্পা.), লোকসংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকা (মাছ-বাঙালি এবং লোকসংস্কৃতি বিশেষ সংখ্যা), এপ্রিল-মে-জুন, ২০০৬।
২. আলপনা ঘোষ, মছলিশ, ২০১৫।
৩. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল ও অনার্য তাপস (সম্পা.), নুনেতে ভাতেতে-১ ও ২। ২০১৬, ২০১৭।