ক্যাফে আমার প্রিয় ক্যাফে

নাগরিক জীবনে জায়গা করে নিয়েছে নানা রকমের ক্যাফে। মডেল: সজীব ও কাব্য, ছবি: সুমন ইউসুফ, কৃতজ্ঞতা: যাত্রা বিরতি
নাগরিক জীবনে জায়গা করে নিয়েছে নানা রকমের ক্যাফে। মডেল: সজীব ও কাব্য, ছবি: সুমন ইউসুফ, কৃতজ্ঞতা: যাত্রা বিরতি
নগরজীবনে বেশ ভালোভাবেই ঢুকে গেছে ক্যাফে সংস্কৃতি। চা–কফির সঙ্গে টুকটাক খাবার খেতে খেতে কখনো–সখনো গান শুনতে শুনতে আড্ডা, কাজের কথা সারার জায়গায় পরিণত হয়েছে ক্যাফেগুলো। ভার্চ্যুয়াল জগতের এই সময়ে ক্যাফে সংস্কৃতি মানুষে মানুষে দেখা–সাক্ষাতের ব্যবস্থা তো করে দিয়েছে। লিখেছেন গাউসুল আলম শাওন

ঢাকা শহরের এই বর্ধিষ্ণু ক্যাফে সংস্কৃতি আমাকে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও অবাক করে। মুগ্ধ করে কারণ, ফেসবুকের এই দূরবর্তী যোগাযোগের জমানায় যে কিছু মানুষ এক জায়গায় বসে কথা বলছে, এক্কেবারে অপরিচিত মানুষ পরিচিত হচ্ছে, প্রেমিক-প্রেমিকা এখনো হাত ছোঁয়াছুঁয়ি করে কথা বলছে, তাই-বা কম কী।

আর অবাক করে কারণ, এমন জনারণ্যে বসে এতটা ব্যক্তিগত হচ্ছে েকউ েকউ। এক টেবিলে পাঁচ বন্ধু তো আরেক টেবিলে ছয় সহকর্মী, আবার তার পাশের ছোট্ট টেবিলটাতেই এক জোড়া কপোত-কপোতী, আর তার পাশেই এক পরিবার তাদের বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়দের নিয়ে এসেছে এটা প্রমাণ করতে যে, ‘হুম…আমাদেরও ক্যাফে আছে’। এই প্রতিটি টেবিলের আলোচনার বিষয়বস্তু কিন্তু বেশ আলাদা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রচলিত বাঙালি সংস্কৃতির জায়গা থেকে বেশ ব্যক্তিগত।

একটু কান খাড়া রাখলেই পাশের টেবিলের ননভেজ জোকটাতে চাইলে আপনিও একচোট হেসে নিতে পারেন। এই ফেসবুকের যুগে অবশ্য কোনো কিছুই আর খুব একটা ব্যক্তিগত নেই। সবার সবকিছু সবার জানা। তারপরও চারদিকে ভাঙনের শব্দ। তারপরও সম্পর্কের স্থায়িত্বকাল ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

তবে চিন্তা নেই, ক্যাফে আছে, নতুন সম্পর্ক তৈরি হওয়া শুরু হলো বলে। হয়তো একাকিত্ব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় এসেছিলেন, আর ফিরে গেলেন নতুন সম্পর্ক তৈরির আভাসের সুবাস নিয়ে।

আমার অবশ্য সবচেয়ে বেশি ঈর্ষা হয় ক্যাফেতে একলা বসে থাকা ওই তরুণকে দেখে। এত ভিড়ের মধ্যেও কীভাবে সব মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে যান যেন বিশ্বমিত্র, কোনো প্রলোভনেই তাঁর ধ্যান ভাঙবে না।

আমার কী মনে হয় জানেন, আসলে এই তারুণ্য–অধ্যুষিত বাংলাদেশের বৈশ্বিক তরুণেরা অধিকাংশই তাঁদের বর্তমান অবস্থানে সন্তুষ্ট নন। ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে সদা মনে হয় জীবন বুঝি অন্য কোনোখানে। তাই এই লাগাতার খোঁজ। পুরোনো সম্পর্ক ভেঙে গেলে নতুন সম্পর্কের খোঁজ ক্যাফেতে। পুরোনো মহল্লা ছেড়ে বন্ধুত্বের আড্ডার নতুন উত্তাপের খোঁজ ক্যাফেতে। বোর্ডরুমে বোর হয়ে যাওয়া কলিগদের কাজের নতুন প্রেরণার খোঁজ ক্যাফেতে। এক ক্যাফে থেকে আরেক ক্যাফেতে, তারপর আরেক ক্যাফেতে।

ক্যাফেগুলো জমে ওঠে তারুণ্যের তুমুল আড্ডায়। ছবি: কবির হোসেন
ক্যাফেগুলো জমে ওঠে তারুণ্যের তুমুল আড্ডায়। ছবি: কবির হোসেন

আর এই ঢাকা শহরে, ঢাকা ছাড়িয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার—নানা শহরে ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্যাফে সংস্কৃতি। নানা তরিকার ক্যাফে, কোনোটাতে চা, কোনোটাতে কফি মুখ্য। কোনোটা খোলা ছাদে, কোনোটা সবুজ উঠানে। কোনো কোনো ক্যাফে আবার বিষয়ভিত্তিক। রবীন্দ্রনাথ থেকে হার্ডরক, ক্যাফের আবহে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। মিউজিক ক্যাফেও জনপ্রিয়—সুরে সুরে আড্ডা, খাওয়া, কফির ম–ম গন্ধ টানে অনেককেই। আর এই সময়ের তরুণ নিত্যই খোঁজ করে সেই বৈচিত্র্যের। আনকোরা, বিচিত্র ক্যাফের খোঁজ চলতেই থাকে।

তবে শিকারি যাযাবর মানুষের এই খোঁজ কিন্তু শুরু হয়েছে সেই লাখো বছর আগে। এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে—এখন বলা যায় এক ক্যাফে থেকে আরেক ক্যাফেতে, এক ওয়েবসাইট থেকে আরেক ওয়েবসাইটে। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন চিন্তা, নতুন সম্পর্ক...তারপর সেটাও একটু একঘেয়ে হয়ে উঠলে আবার নতুনের খোঁজ। সবাই যেন একেকজন কলম্বাস। তাই আজকের ক্যাফে সংস্কৃতিও শেষ পর্যন্ত মানুষের উত্তরণের গল্প, এগিয়ে যাওয়ার গল্প, পরিবর্তনের গল্প। চা থেকে কফিতে চুমুক দিয়ে নতুন স্বাদ খুঁজে পাওয়ার গল্প। এই নতুনের খোঁজের অভিযাত্রায় আবার কখনো যদি পুরোনোর মুখোমুখি হয়ে যায়, সেটাও মন্দ নয়, অনেক দিন পরের সেই পুরোনোকে তখন বেশ নতুনই লাগে। সেই পুরোনোকে জড়িয়ে ধরুন নতুন করে। সম্পর্কের ওমের আদান-প্রদান হোক। নতুন ক্যাফেতে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে দুহাতে জড়িয়ে ধরুন, জিজ্ঞাসা করুন, ‘বন্ধু, কী খবর বল? কত দিন দেখা হয়নি...।’ এই যাযাবর, ছিন্নমূল মানুষের নিরন্তর খোঁজ চলতে থাকুক ক্যাফে থেকে ক্যাফেতে।

লেখক: গ্রে অ্যাডভারটাইজিং ঢাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক