কীভাবে বুঝবেন শিশু অটিজমে আক্রান্ত

বিশেষ শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় মায়ের সহযোগিতা একটু বেশিই প্রয়োজন। ছেলে আদিতের সঙ্গে মা ফারহানা এ রহমান। ছবি: সংগৃহীত
বিশেষ শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় মায়ের সহযোগিতা একটু বেশিই প্রয়োজন। ছেলে আদিতের সঙ্গে মা ফারহানা এ রহমান। ছবি: সংগৃহীত
গতকাল ২ এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্নদের অধিকার

অয়নের (ছদ্মনাম) বয়স সাড়ে তিন বছর। কিন্তু সে ঠিকমতো কথা বলতে শিখেনি। মাত্র দু–একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, কিন্তু সেগুলো দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। বাবা-মা বা অন্য কারও চোখে চোখ রেখে তাকায় না। একা একা থাকে, বাড়িতে ওর বয়সী কোনো শিশু এলে তাদের সঙ্গে মেশে না। মাঝেমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, কখনো নিজেকে আঘাত করে, একই কাজ বারবার করে। যেমন বারবার হাতে তালি দেয়, মেঝের ওপর ঘুরতে থাকে।
অয়ন একজন অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো কারণে স্নায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।

যদি দেখা যায়—

*  ৬ মাস বয়সের মধ্যে শিশু একা একা না হাসে

*  ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল বলতে পারছে না, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা করছে না

*  ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে পারে না

*  ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না

*  ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাচ্ছে

  *  বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করছে না

এসব লক্ষণ দেখা গেলে তখন তাকে অবশ্যই অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না, বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়:

*  সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা

*  বারবার একই ধরনের আচরণ করা

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা শিশুরা সামাজিকতা পালন করতে পারে না, নিজের আগ্রহ, আবেগ আর অনুভূতি অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না, যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না এবং যদি সে কথা বলতেও পারে, তবু আরেকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ ঠিকমতো কথা বলতে পারে না বা একেবারেই কোনো অর্থবোধক শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না এবং পরিবেশ অনুযায়ী মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে না, অর্থাৎ ভয় পেলে বা খুশি হলে মুখ দেখে বোঝা যায় না। অটিজম আছে এমন শিশুরা কল্পনা করে খেলে না। যেমন নিজেকে কোনো চরিত্র ভেবে বা কোনো সাধারণ বস্তুকে গাড়ি বা প্লেন বানিয়ে খেলতে পারে না। সহজে বন্ধু তৈরি করতে পারে না এবং অপরের বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম তৈরি হয়।

একই ধরনের আচরণ বারবার করতে পারে। যেমন হাতে তালি দেওয়া, মেঝেতে ঘুরতে থাকা, বারবার আঙুলের সঙ্গে আঙুল প্যাঁচানো। কখনোবা একটি বস্তুকে বারবার একই রকমভাবে ব্যবহার করা। যেমন খেলনা গাড়ির চাকা বারবার ঘোরানো, কখনোবা একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করা। অটিজম আছে এমন যারা কথা বলতে পারে, তারা দেখা যায় একই প্রশ্ন বারবার করছে বা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটিই বারবার উচ্চারণ করছে। যেমন যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তোমার নাম কী?’ তবে সে নিজের নাম না বলে বলতে থাকে—‘তোমার নাম কী? তোমার নাম কী? তোমার নাম কী?’—এই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা রুটিন বা প্যাটার্ন মেনে চলতে পছন্দ করে, রুটিনের ব্যতিক্রম হলে রেগে যায় বা মন খারাপ করে। অনেক সময় একই চিন্তা বা একই কাজ বারবার করার অভ্যাস থাকে, আবার কখনো একটি বিশেষ বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তৈরি হয়। যেমন খেলনা গাড়ি, চশমা, কলম ইত্যাদি সংগ্রহ করতে চায়। শব্দ বা স্পর্শের প্রতি অস্বাভাবিক সাড়া দেয়। যেমন অল্প শব্দেই ভীত হয়ে পড়ে বা অনেক জোরের শব্দেও কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তেমনি অল্প স্পর্শেই ব্যথা পায় বা অস্বস্তিবোধ করে, আবার উল্টোটাও হতে পারে, অনেক ব্যথা পেলেও কাঁদে না।

কখন প্রকাশ পায়, কারণ কী?

সাধারণত শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের পর্যায়ে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৮ মাস থেকে ৩৮ মাস বয়সের মধ্যেই) অটিজমের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়।

অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু বিষয়কে অটিজমের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন: বংশে কারও অটিজমের সমস্যা, মায়ের গর্ভকালীন সংক্রমণ (রুবেলা, মিসেলস, মাম্পস), জন্মের সময় শিশুর ওজন কম থাকা, গর্ভকালীন সময়ে বিষাক্ত সিসাযুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, প্রসবকালীন কোনো জটিলতা, মা ও শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যা।

যেসব সমস্যা থাকতে পারে

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে খিঁচুনি (মৃগী), অতিচঞ্চলতা (হাইপার অ্যাক্টিভিটি), বুদ্ধির ঘাটতি, হাতের কাজ করতে জটিলতা, হজমের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, খাবার চিবিয়ে না খাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ (২০১৮ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম রয়েছে। মেয়েশিশুদের তুলনায় ছেলেশিশুদের অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকার আশংকা প্রায় ৪ গুণ বেশি। বিগত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে অটিজমের হার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এর মূল কারণ, বারবার অটিজমের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে, ফলে অটিজমের বৈশিষ্ট্যের পরিধি বেড়েছে।

চাই সামাজিত সচেতনতা

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বহুগুণ বেড়েছে। আগের চাইতে অনেক বেশি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা শনাক্ত হচ্ছে এবং সঠিক পরিচর্যা ও সেবা পাচ্ছে। কিন্তু এরপরও অটিজম নিয়ে রয়ে গেছে কিছু ভ্রান্ত ধারণা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের মা–বাবারা সহজে মেনে নিতে চান না যে সন্তানের অটিজম রয়েছে। ফলে দীর্ঘসময় একটা বিভ্রান্তিতে থাকতে থাকতে উপযুক্ত পরিচর্যা আর প্রশিক্ষণের সময় নষ্ট হয়ে যায়। সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং উপদেশ মেনে নিতে হবে। এরপর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর প্রয়োজনে বিশেষ কিছু সমস্যার ওষুধ সেবন করতে হবে। অটিজম আছে এমন শিশুদের আচরণজনিত সমস্যা, অতিচঞ্চলতা, অস্থিরতা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা, খিঁচুনি বা খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদির জন্য পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই সীমিত আকারে ওষুধের প্রয়োগ রয়েছে। এই ওষুধ তাকে প্রশিক্ষণের উপযোগী করে তুলবে এবং সহযোগী সমস্যাকে কমাবে। তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে।

দরকার সম্মিলিত পরিচর্যা্

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের পরিচর্যার জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে তা হলো:

*  বাবা–মায়ের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ

*  শিক্ষক, চিকিৎসক, থেরাপিস্টসহ সবাইকে সম্মিলিতভাবে পরিচর্যায় অংশ নেওয়া

*  কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য শিশুকে উৎসাহিত করা

*  শুরুতে সাধারণ মূলধারার স্কুলে প্রেরণ

*  স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতেও শিশুকে সামাজিক রীতিনীতি শেখানোর চেষ্টা

*  সামাজিক অনুষ্ঠানে শিশুর অংশগ্রহণ

*  শিশুর উৎসাহের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া, সেটির চর্চা করা (যেমন ছবি আঁকা, গান গাওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদি)

*  প্রয়োজনে বিশেষায়িত স্কুলের সাহায্য নেওয়া

*  ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা (স্পিচ থেরাপি), প্রয়োজনে ইশারা ভাষা শেখানো

*  অকুপেশনাল থেরাপি (দৈনন্দিন কাজ, বৃত্তিমূলক কাজ ইত্যাদি শেখানো)

*  সাইকোথেরাপি, প্লে–থেরাপি, সেনসরি ইন্টিগ্রেশন (সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কৌশল) ইত্যাদি

*  সমস্যা অনুযায়ী কিছু ওষুধ প্রদান, তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী

অটিজমের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় আর পরিচর্যার জন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। ভ্রান্ত ধারণা আর বিষয়টিকে অস্বীকার করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। আধুনিক যুগের যত ধরনের সহায়ক প্রযুক্তি রয়েছে, তার উপযুক্ত প্রয়োগ করে অটিজম আছে এমন ব্যক্তিরা আরও গুণগত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারবে, নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারবে। অটিজমকে ভয় না পেয়ে অটিজম আছে এমন শিশুকে আড়ালে না রেখে উপযুক্ত পরিচর্যা আর সেবা দেওয়া প্রয়োজন। এতে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিরা সমাজে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী অবদান রাখতে পারবে।

আহমেদ হেলাল : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।