আগুন থেকে নিরাপদ থাকতে যা করবেন

যথাযথভাবে নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করলে এবং পরে সচেতন থাকলে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। ছবি: ভলিউমজিরো
যথাযথভাবে নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করলে এবং পরে সচেতন থাকলে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকা যায়। ছবি: ভলিউমজিরো
চুড়িহাট্টা থেকে বনানী—ঢাকার দুই প্রান্ত আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেপুড়ে ছারখার। মর্মান্তিক দুই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে অনেক। সবার মনে আতঙ্ক। ঝুঁকিতে আছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক ভবন। আগুন লাগার আগে সতর্কতা এবং আগুন লাগলে করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন চারজন বিশেষজ্ঞ।
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জামিলুর রেজা চৌধুরী

সচেতন হলে ঝুঁকি কমে যায়
জামিলুর রেজা চৌধুরী
জাতীয় অধ্যাপক এবং উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক অগ্নিকাণ্ডের পর আমরা পুরোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়নেই আটকে আছি। ২৬ বছর আগে ভবন নির্মাণের নীতিমালা প্রণীত হয়েছিল। এর মধ্যে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নতুন প্রযুক্তি এসেছে। ফলে পুরোনো সেই নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়েছে। সেটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটিই আসলে এখনকার প্রাথমিক পদক্ষেপ।

দেশে এখন যেভাবে ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে, সেখানে উপদেশ বা পরামর্শ কোনো কাজে আসবে না। উন্নত দেশগুলোতে অনেক নিয়মকানুন আছে। যেমন: আগুন লাগলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মাথা ঢাকতে হবে, দরজার নিচের অংশ বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে ধোঁয়া না ঢোকে ইত্যাদি। কিন্তু এসব প্রয়োগ করার মতো পরিস্থিতি আমাদের অধিকাংশ ভবনে নেই। তাই ভবন যথাযথ নিয়মে নির্মাণ করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বনানীর এফ আর টাওয়ারে ইমার্জেন্সি এক্সিট (জরুরি অবস্থায় নামার জন্য সিঁড়ি) বন্ধ ছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভবন নির্মাণে নিয়ম মানা হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের অভাবও ছিল। তবে আমাদের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো বিদেশি ক্রেতাদের চাপে অনেকটাই নিয়ম মানছে। তাদের কর্মীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

ফায়ার সার্ভিসকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাদের জনবল এবং উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা এখন জরুরি প্রয়োজন। এ ছাড়া ভবনের বাসিন্দাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও জরুরি। এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস চাইলে সহযোগিতা করবে। আগুন লাগলে কী করতে হবে না হবে, সব তারা দেখিয়ে দেবে। নিজেরা সচেতন হলে ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।

মো. ফয়েজ উল্লাহ
মো. ফয়েজ উল্লাহ

আইনের প্রয়োগটাই আসল
মো. ফয়েজ উল্লাহ
মুখ্য স্থপতি, ভলিউমজিরো

কোনো ভবনে যে আগুন লাগবে না, এটা হলফ করে বলা কঠিন। তাই আগুন লাগার আগে ও পরে যা যা করণীয়, তা জানা এবং মেনে চলাই বাঁচার উপায়। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। যেসব প্রযুক্তি আগুন লাগলেই নির্ণয় করতে পারবে। অ্যালার্ম বাজবে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বন্ধ হয়ে যাবে নিজে থেকেই। জেনারেটর বা এ রকম কোনো যন্ত্রপাতি থাকলে পানি দিয়ে নেভানো যায় না। এ ক্ষেত্রে গ্যাস বা পাউডার ব্যবহার করা হয়। এরপর ভবনের বাসিন্দারা নিজেদের রক্ষা করবে। এ জন্য দরকার নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মহড়া। আমাদের আইন না মানার সংস্কৃতি আছে। এসব দেখভাল করার দায়িত্ব যাঁদের ওপর, তাঁরা নিষ্ঠাবান হলেই হয়।

ভবন নির্মাণের সময় স্থাপত্য নকশা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নকশা যিনি বাস্তবায়ন করবেন, তাঁর সঙ্গে স্থপতির দূরত্ব থাকলে চলবে না। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির তো কোনো বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই ভবন নির্মাণের জন্য প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদেরও এটা করার সময় এসেছে। নতুন আইনে ২০২২ সালের মধ্যে সময় বেঁধে দেওয়া যায়। যেখানে বলা হয়েছে, নিয়ম না মানলেই ভবন নির্মাণ স্থগিত হয়ে যাবে এবং পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলেও ভবন ব্যবহারের অনুমতি মিলবে না। তবে কেবল আইন করলেই তো হয় না, প্রয়োগটাই আসল।

আমরা অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনার পর কেবল প্রতিক্রিয়াই লক্ষ করি। আসলে আমাদের কাজটা করে দেখাতে হবে। রোগ হলে যেমন চিকিৎসা দিতে হয়, তেমনই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনাও দেখার বিষয়। এ ক্ষেত্রেও তা–ই। জাতীয় ভবন নির্মাণ নীতিমালা অনুযায়ী নির্মাণকাজ বাধ্যতামূলক করতে হবে। রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে সবাইকে এ িবষয়টি দেখতে হবে।

ছবি: সাজিদ হোসেন
ছবি: সাজিদ হোসেন
মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা
মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা

বৈদ্যুতিক নকশা মহাগুরুত্বপূর্ণ
মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা
প্রকৌশলী এবং প্রিন্সপাল ডিরেক্টর, শামস ইঞ্জিনিয়ারিং

প্রথম কথা, ভবন নির্মাণের নকশায় ত্রুটি থাকা চলবে না। এটা যাঁদের দেখার দায়িত্ব, তাঁরা ঠিকঠাকভাবে পালন করলেই হয়। তারপরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সচেতনতা। যেখানে একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বালানোর কথা, সেখানে রুম হিটার চালানো যাবে না। কারণ, টেবিল ল্যাম্পের জন্য যে তার ব্যবহার করা হয়, সেটির একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সহনশীলতা আছে। সেটাতে রুম হিটার চালাতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই বেশি চাপ পড়বে। এর ফলে অবধারিতভাবেই শর্টসার্কিট হবে। ভবন নির্মাণের সময় বৈদ্যুতিক নকশাও যথাযথ হওয়া মহাগুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুতের বিল না দিলে যেমন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, তেমনই বিদ্যুতিক নকশা মেনে না চললেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

কেবল নকশা করেই বসে থাকলে চলবে না। নকশা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সেটা দেখার বিষয়। তারপর নিয়মিত দেখভালও জরুরি। ভবনের বাসিন্দাদের কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রতিবার বাসায় ঢোকার সময় যেকোনো বৈদ্যুতিক সুইচ চালু করার আগে দরজা–জানালা খুলে দিন। রান্নাঘর ও বাথরুমের এক্সহস্ট ফ্যান চালু করুন। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যেখানে যেটা ব্যবহার করার কথা, সেখানেই করুন। এসি যেহেতু বাইরে থাকে, তাই দিনে বেশ কিছুটা সময় জানালা খুলে রাখুন। বাইরের বাতাস আসা–যাওয়া করলে এসির ওপর চাপ কম পড়বে। সব মিলিয়ে সচেতনতা বাড়ানোই জরুরি।

দিলীপ কুমার ঘোষ
দিলীপ কুমার ঘোষ

আগে প্রতিরোধ, এরপর আগুন নেভানো
দিলীপ কুমার ঘোষ
সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স

অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে দুই ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আগে প্রতিরোধ, পরে আসে নির্বাপণে করণীয়।
আগুন লাগার আগে যা মনে রাখবেন—
*  রান্নার পর চুলা সম্পূর্ণভাবে নিভিয়ে ফেলুন।
*  ভেজা জামাকাপড় চুলার ওপর শুকাতে দেবেন না।
*  গ্যাসের চুলা জ্বালানোর কমপক্ষে ১৫ মিনিট আগে রান্নাঘরের সব দরজা–জানালা খুলে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করুন।
*  গ্যাসের চাবি চালু করার আগে ম্যাচের কাঠি ধরাবেন।
*  গ্যাসের চুলার হোস পাইপটি ফাটা বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবর্তন করুন।
*  বাসার বৈদ্যুতিক লাইন প্রতি ছয় মাস পরপর নিয়মিত পরীক্ষা করুন।
*  উন্নত মানের বৈদ্যুতিক তার/ সরঞ্জাম ব্যবহার করুন।

*  যেখানে যে সরঞ্জাম ব্যবহারের কথা, সেখানে সেটাই ব্যবহার করুন। ইস্তিরি, রুম হিটার, ফ্রিজ বা এ রকম ভারী যন্ত্র চালাতে নির্দিষ্ট সকেট ও প্লাগ ব্যবহার করুন।

*  অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মূল লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখুন।

*  ক্ষতিগ্রস্ত বা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার/ সরঞ্জাম বদলে ফেলুন।

*  কোনো যন্ত্রই সারা দিন একটানা চালাবেন না। বিশেষ করে এসি চালানোর মাঝখানে বিরতি দিন।

*  বজ্রপাতের সময় ডিশ–অ্যানটেনা ও রাউটারের সংযোগ খুলে রাখুন।

*  বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিপ্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।

*  ঝুঁকি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র মজুত রাখুন।

*  অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের প্রয়োগ ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিন।