সংসার সুখের হয় বোঝাপড়ার গুণে

সুস্থ সম্পর্ক জীবনে স্থিতি ও শান্তি আনে। মডেল: বাপ্পা ও অর্পিতা, ছবি: প্রথম আলো
সুস্থ সম্পর্ক জীবনে স্থিতি ও শান্তি আনে। মডেল: বাপ্পা ও অর্পিতা, ছবি: প্রথম আলো

আমাদের নতুন বাসার পাশের প্রতিবেশী এক চীনা দম্পতি। স্বামী ও স্ত্রীর বয়স হবে আনুমানিক সত্তর বছর ও ষাট বছর। মাস দেড়েক হলো উঠেছি এ বাসায়। এর মধ্যে ভদ্রলোক দু–একবার হাসি বিনিময় করে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন বলছি ঠিকই তবে তিনি যে আসলে কী বলেছেন তার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারিনি। গত পরশু দিন বিকেলে তিনি হঠাৎ বাসার পেছন দিকে গিয়ে আমার জানালায় এসে তাঁর মোবাইলটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দেখালেন, তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘প্রতি শুক্রবার গির্জায় ফ্রি ইংরেজি ক্লাস হয়, তুমি কি তোমার বাবা–মাকে নিয়ে যেতে চাও’। কবে থেকে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি ইশারা করে বললেন, বাইরে এসো বলছি। আমি কালবিলম্ব না করে বাইরে চলে গেলাম। ভদ্রলোককে প্রথম দিন দেখেই আমার কেন জানি না খুব মায়া লেগেছিল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় অতিশয় শান্ত প্রকৃতির।

বাইরে এসে জানতে চাইলাম, ক্লাস কবে থেকে। ভদ্রলোক কানে খুব কম শোনেন। আমার গলার স্কেল বাড়িয়ে দিলাম। তিনি তৎক্ষণাৎ মোবাইলটা মুখের কাছে নিয়ে চায়নিজ ভাষায় কী সব হাবিজাবি বলতে লাগলেন। পরক্ষণেই দেখলাম মোবাইলের স্ক্রিনে স্পষ্ট অক্ষরের বাংলা তর্জমা লেখা ভেসে উঠছে। তাতে লেখা, ‘আমার বউ খুব খারাপ। আমাকে কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয় না। ও বলছিল, আজ সকালে তুমি তাকে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলেছ। ঘরে ঢুকেই সে আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, আমি যেন তোমার সঙ্গে কথা না বলি। আমার স্ত্রী সবাইকে ঘৃণা করে।’

মোবাইলে এই তর্জমা দেখে আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘তবে যে কথা বলছ, সে দেখলে তো তোমাকে রাগ করবে’।

লিসু আমার কথা বুঝতে পারলেন না। লিসু, ও হ্যাঁ ভদ্রলোকের নাম লিসু। তিনি এবার মোবাইলটা তাঁর নিজের মুখের কাছে না ধরে ধরলেন আমার মুখের কাছে। আমি ইংরেজিতে বললাম, ‘হোয়াই আর ইউ টকিং উইথ মি, ইওর ওয়াইফ উইল অ্যাংরি’। লিসু আমার ইংরেজির চায়নিজ তর্জমা করে পড়ে নিলেন। তারপর আবার গড়গড় করে চায়নিজ ভাষা বলতে লাগলেন এবং পূর্বের মতো সেটার বাংলা করে দেখালেন। তাতে লেখা তার স্ত্রী দশ দিনের জন্য চীন গেছেন। এই সময়ে তিনি আমার আব্বা–মাকে ইংরেজি শিক্ষার জন্য গির্জায় নিয়ে যেতে চান।

এই কথা শুনে আমি আরও ভয় পেলাম। তাঁর স্ত্রী আদৌ চীন গেছেন না বাড়ির ধারে কাছে কোথাও আছেন কে জানে। আব্বা মায়ের ইংরেজি শিক্ষা শিকেয় তুলে স্ত্রী জ্বালায় জর্জরিত লিসুর গহিন হৃদয়ের বেদনা অনুভব করে পড়িমরি অবস্থায় আমি ঘরে ঢুকি। পাছে আমার কারণে লিসুর প্রাণ যায়।

লিসুর সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকে আমার মাথার মধ্যে চরকির মতো একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো ঘর করা আর ঘর বাঁধা এ দুটো কথার মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। মোটের ওপর ‘ঘর করা আর ঘর বাঁধা আসলে এক কথা নয়’।

এই যে লিসু, আমার মতো অচেনা একজন মানুষের কাছে কত অবলীলায় তাঁর বউয়ের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য ছুড়ে দিলেন। তার বউয়ের কাছে লিসুর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনিও হয়তো লম্বা এক লিস্ট ধরিয়ে দিতেন।

আমরা মনুষ্য প্রজাতি ঘর বাঁধার জন্য দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হয়েও বেশির ভাগ মানুষ ঘর না বেঁধে আমরা ঘর করি। ঘরটাও আবার সাধে করি না। করি লোকচক্ষুর ভয়ে, সমাজের ভয়ে। কেউবা আবার সন্তানের মঙ্গলের জন্য। লিসু আর তার বউ হয়তো এমনই এক দম্পতি যারা ঘর না বেঁধে ঘর করছেন। এই ধরনের ঘর করার মধ্যে কোনো প্রেম থাকে না, মায়া থাকে না। থাকে কেবল সন্দেহ আর কিছু দায়বদ্ধতা। এই দায়বদ্ধতা রক্ষার্থেই লিসুরা বছরের পর বছর এক ছাদের তলে থাকেন। অথচ ঘর বাঁধলে সে ঘরে প্রেম থাকত। মায়া থাকত। বিশ্বাস থাকত। অপেক্ষার প্রহর থাকত।

লিসু হয়তো জানেন না, সামান্য একটু বোঝাপড়াই পারত লিসুর পুরো পৃথিবী বদলে দিতে। বোঝাপড়াটা এমন কঠিন কিছু না। একজন অন্যজনের ভালো লাগার প্রতি সম্মান দেখানো, এই যা। এমনটা তো হতেই পারত লিসুর একটা ইতিবাচক সাড়া লিসুর স্ত্রীর দুটি নেতিবাচক আচরণ বদলে দিয়েছে। ভালোবাসার বিনিময়ে যেমন ভালোবাসা পাওয়া যায় তেমনি সম্মানের বিপরীতে সম্মান। অথচ হয়েছে এর উল্টোটা। অবজ্ঞা, অবহেলা, মানসিক দূরত্ব লিসু আর লিসুর স্ত্রীর সম্পর্ককে করেছে ম্রিয়মাণ।

আমরা ধৈর্যশীল নই বলেই মুহূর্তের মধ্যে খুব সহজ বিষয়গুলোকে জটিল করে দেখি। আর তার মাশুল গুনি দীর্ঘ সময় ধরে। লিসু বোধকরি, সে দলেরই একজন। এ পর্যায়ে বলে রাখা ভালো, খুঁটিনাটি ঝগড়াঝাঁটি-কথাকাটাকাটি এগুলো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলোকে মহামারিতে রূপদান না করলেই হলো। কারণ, জীবনে সকল প্রকার প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার আনন্দ সুখকর হলেও শুধুমাত্র পারিবারিক যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ, যে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই। আছে তীব্র উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা। জয়ী হয়েও ভালো না থাকার তীব্র যন্ত্রণা। এমন জয়-পরাজয় কারও জন্যই কাম্য নয়।

একটা কথা বলে শেষ করতে চাই ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর’। তাই, আমাদের ঘর বাঁধার মূল মন্ত্র হোক ‘বিশ্বাস’।
...

লাভলী ইয়াসমীন: সেন্ট্রাল কোস্ট (গজফোর্ড), নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।