ঢাকার ইফতারি এখন ও তখন

পবিত্র রমজান মাস এলেই শুরু হয় বাহারি ইফতারি তৈরির আয়োজন। ঘরে ঘরে তো বটেই, দেশের প্রতিটি শহরে, প্রতিটি মহল্লার রেস্তোরাঁতেও তৈরি হতে থাকে হরেক পদের ইফতারি। ঢাকা শহরের ইফতারি সংস্কৃতিতে ইদানীং যোগ হয়েছে অনেক নতুন অনুষঙ্গ। অর্ডার করলে ঘরে বসে পাওয়া যায় বিভিন্ন রেস্তোরাঁর সুস্বাদু খাবার। তবে ঢাকার ইফতারির সুনাম অনেক পুরোনো। ঢাকাই রন্ধনশিল্পীদের হাতে তৈরি ইফতারির একটা দীর্ঘ পরম্পরা আছে, সেটা বোঝা যায় পুরান ঢাকার অলিগলিতে ঘুরলেই। চানখাঁর পুল থেকে চকবাজার, পুরান ঢাকার তিপ্পান্ন গলির ইফতারির ইতিহাস ঘোরে মানুষের মুখে মুখে।

ঢাকা মানেই মোগলাই খানা। আজ থেকে এক শ–দেড় শ বছর আগে এই মোগলাই খানা এখনকার মতো ঠিক ‘বাঙালি মোগলাই’ হয়ে ওঠেনি। সবাই মোটামুটি মোগলাই খাবার পছন্দ করত ইফতারের সময়। প্রতিটি বাড়িতে কোফতা, কোর্মা, কালিয়া রান্না করা ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। কারণ, এগুলো রুটি ও ভাত দুইয়ের সঙ্গেই খাওয়া যায়। ঢাকাবাসী সাহ্‌রির জন্য সাধারণভাবে কোর্মা এবং শিরবিরিঞ্জ বা দুধের পায়েস বেশি পছন্দ করত।

‘রমজান মাসে প্রতিটি ঘরেই শ্রেষ্ঠ খাবার রান্না হতো।’ ধনী-গরিবনির্বিশেষে সব পরিবারেই ইফতারের আয়োজন করা হতো সাধ্যমতো। ইফতারে বাড়িতে তৈরি খাবার ছিল প্রধান। ইফতারে ছোলা খাওয়ার প্রচলন এখনকার মতো অতীতেও ছিল। বাজারের কেনা ছোলা পরিষ্কার করে রাখা হতো ইফতারিতে ব্যবহার করার জন্য। বাঙালিদের মধ্যে ডালের অঙ্কুর খাওয়ার প্রচলন না থাকলেও ঢাকা শহরে বসবাস করা ইরাকি বা ইরানি পরিবারগুলোতে মুগডালের অঙ্কুর খাওয়া চলত। নতুন হাঁড়িতে সারা রাত মুগডাল ভিজিয়ে রাখা হতো অঙ্কুর বের হওয়ার জন্য এবং ইফতারের সময় সেটা খাওয়া হতো।

নোনতা ও মিষ্টি সমুচা, কাঁচা ও ভাজা ডাল, ফল-ফলাদি, পেঁয়াজি, ফুলুরি, নার্গিসি কাবাব, মুরগির শিককাবাব, হান্ডি কাবাব ইত্যাদি অধিকাংশ বাড়িতেই তৈরি করা হতো। রুটি ও পরোটা দিয়ে কাবাব খাওয়া ছিল বেশ জনপ্রিয়। বাড়িতে বানানো ইফতারের পাশাপাশি বাজার থেকে কেনা শিককাবাব, ভুনা চিড়া, দোভাজা, টেপি ফুলুরি, মাষকলাইয়ের বড়া, ডাল-বুট ইত্যাদিও ছিল জনপ্রিয়। ঢাকার মানুষ বাকরখানি খাবে না, তা কি হয়? সাদা বা পনিরযুক্ত বাকরখানি ছিল ইফতারের গুরুত্বপূর্ণ খাবার। পুদিনাপাতা, ক্ষিরা, ধনেপাতা, বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফলও থাকত ইফতারে। লেখক ও গবেষক হাকিম হাবিবুর রহমান জানাচ্ছেন, যে মৌসুমেই রমজান হোক না কেন, ঢাকায় পুদিনাপাতা, ক্ষিরা আর ধনেপাতা পাওয়া যাবেই। আর পাওয়া যেত আখ। গোলাপ বা কেওড়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে সুবাসিত করা হতো এগুলো।

নানা ধরনের পানীয় ও শরবত তৈরি হতো রমজানের সময়। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ছিল ফালুদা ও তোকমার শরবত। বেলের শরবতও ছিল তালিকায়। ‘বেশি গরম মেজাজের লোকেরা’ লেবুর শরবত অথবা তেঁতুল ও গুড় দিয়ে বানানো শরবত পান করতেন ইফতারের সময়।

ঢাকা শহরের অভিজাত পরিবারগুলো মসলার পাশাপাশি গোলাপ ও কেওড়া ফুলও ব্যবহার করত খাদ্য সুবাসিত করতে। রমজানের শুরুতে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবাই সাধ্যমতো গোলাপ বা কেওড়া কিনত খাদ্যদ্রব্য সুগন্ধযুক্ত করার জন্য।

এ তো গেল অন্দরের কথা। ঘরের বাইরেও ইফতারের যে একটা বিশাল জগৎ আছে, সেটা কেনা জানে। আজ থেকে এক-দেড় শ বছর আগেও ইফতারের জন্য চকবাজার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রমজানে সুস্বাদু ইফতারের ঘ্রাণে ম–ম করত চকবাজার। বাড়িতে তৈরি খাবারের পাশাপাশি সবাই কমবেশি চকবাজার থেকে কিছু না–কিছু কিনে নিয়ে যেত বাড়ির মানুষের জন্য। বিভিন্ন ধরনের পিঠা এবং রমজানের বিশেষ বিশেষ জিনিস এই চকেই পাওয়া যেত—এখনো যেমন যায়। আজ থেকে আনুমানিক দেড় শ বছর আগে চকে আলাউদ্দিন হালুয়াই খাবারের দোকান খুলেছিলেন লক্ষ্ণৌ থেকে এসে। নিমক পারা, সমুচা এবং লক্ষ্ণৌ শিরমাল শুধু তাঁর দোকানেই পাওয়া যেত।

এতক্ষণ পর্যন্ত যা আলোচনায় এল, তার প্রায় সবই বিশেষ ধরনের মোগলাই খাবার। বিশেষ ধরনের বলা হলো এ কারণে যে আমরা ঢাকার খাবারের ঠিক যে সময়ের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে, সে সময় খাবারে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ বাঙালির হাতে পড়ে মোগলাই খাবারও মোটামুটি তার শুদ্ধতা হারিয়ে কখনো উৎকৃষ্ট হয়েছে, কখনোবা অপকৃষ্ট। তবে নিঃসন্দেহে মোগল কিংবা কাশ্মীরি পরিবারগুলো পারিবারিকভাবে তাদের খাবারের আভিজাত্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। এখনো সেটা দেখা যায় পুরান ঢাকায়।

ইফতারির অন্যতম আকর্ষণ মুড়ি। এই একটি বিষয়ে অতীত-বর্তমান, বাঙালি-কাশ্মীরি কোনো পার্থক্য ছিল না। রোজায় প্রতিটি ঘরে মুড়ি অত্যাবশ্যকীয় ছিল বলেই জানা যায়। পেঁয়াজ, মরিচ, তেলসহযোগে মুড়ি মাখানো হতো। শুধু যে সাধারণ মানুষ মুড়ি খেত, তা নয়। ভাজা মুড়ি ও ভাজা পনির ‘ভালো ভালো ঘরে’ও খাওয়া হতো ইফতারে। ইফতারের সময় খাবারের বিভিন্ন পদের সঙ্গে মুড়িরও বিভিন্ন ‘আইটেম’ আসত দস্তরখানে। মুড়ি বাঙালির জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে বাংলাই এর উৎস না, এটি ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছে’, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

সন্দেহ নেই যে এই একুশ শতকে এসে আমাদের রসনাবিলাসে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। ‘ইফতারে চাই বাহারি খাবার’—এ ব্যাপারে কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। আর এ জন্যই মনে হয় ইফতারির একটা ‘বাহিরানা’ তৈরি হয়েছে। অন্দরের সেই বৈচিত্র্য ছাপিয়ে সদরের বৈচিত্র্য দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবখানে। চকবাজার এখনো আছে। পাশাপাশি নতুন ঢাকার বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল থেকে গলির মোড়ের দোকান—সবাই ‘ঈদ স্পেশাল’ নিয়ে ব্যস্ত। মানুষও ছুটছে সেখানেই। মিলছে নানান পদ, ভিন্ন স্বাদ।

তথ্যঋণ: হাকিম হাবিবুর রহমান, ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে, অনুবাদ, ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম, প্যাপিরাস। ২০০৫।