অভিমানী রবীন্দ্রনাথের কান্না

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অভিমান—সে বড় আজব জিনিস! যত বিখ্যাত, যত তারকা, যত বরেণ্যই হন না কেন, মনের গহিন–গোপন কোণে অভিমানের বাষ্প জমা হয় মানুষের। রবীন্দ্রনাথেরও হয়েছিল। প্রকাশ্যে তাঁকে অভিমান করতে খুব কম মানুষই দেখেছিলেন। কিন্তু যাঁদের সৌভাগ্য হয়েছিল, তাঁর সঙ্গে একান্ত সময় কাটানোর, মধ্যদুপুরে বিশ্রামের কিংবা জোছনা রাতে মন খুলে কথা বলার, গান গাওয়ার, তাঁদের কারও কারও সামনে তিনি কখনো–সখনো সজল অভিমানী হয়েছিলেন। খুব কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের ভেজা চোখের অভিমান দেখেছিলেন লেখিকা রানী চন্দ।

‘কখনো-বা তাঁর মায়ের গল্প পড়তে পড়তে বলতেন, “মাকে আমরা জানি নি, তাঁকে পাই নি কখনো। তিনি থাকতেন তার ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনত—যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর।… মায়ের ঝোঁক ছিল জ্যোতিদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) আর বড়দার (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) উপরেই। আমি তো তার কালো ছেলে।”’ (ঘরোয়া–রানী চন্দ) ভীষণ অভিমান ভরে একটি শিশু যখন তার মাকে বলে, আমি না থাকলে বুঝবে, তখন মা তাকে ভরসা দেবার জন্য গভীর মমতায় জড়িয়ে নেন বুকে। কিন্তু তাবড় তাবড় লেখকের লেখা আর স্মৃতিকথা পড়ে কোথাও পাওয়া যায় না, শিশু রবীন্দ্রনাথ ভীষণ অভিমানী হলে মা সারদা দেবী তাঁকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সে জন্যই লেখিকা রানী চন্দের সামনে জীবনের শেষ প্রান্তের কোনো এক বিষণ্ন দুপুরে অভিমানে সজল হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্র।

রবীন্দ্রনাথ মা ছাড়া শৈশব আর কৈশোরের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে জানালার গারদ ধরে তাকিয়ে থাকতেন বাইরে। মহাকাল অতিক্রম করা বুড়ো চীনে বটের অভিজ্ঞ ঝুরি তাঁকে গল্প শোনাত—সন্ধে নামার আগে নারকেল আর সুপারিগাছের চিরল পাতায় চুইয়ে পরা গোধূলি অতিক্রান্ত ঘনঘোর অন্ধকারে ‘হা রে রে’ করে ওঠা অচিনপুরের ডাকাতদের। আর বালক রবীন্দ্রনাথ বাঁধতেন পালকি চড়া এক মায়ের গল্প,

‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।

তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে

দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,

আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে

টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।

রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে

রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।…’

আদরে, স্নেহে বড় হতে থাকা শিশুদের মাকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস থাকে, ন্যাওটা হয়ে থাকার যে মানসিক প্রশান্তি থাকে, রবীন্দ্রনাথের সেটা ছিল না বলে মা ছাড়া বিষণ্ন দুপুর তাঁকে বড় বেলাতেও তাড়া করে ফিরেছিল। ছোটবেলার সেই বিষণ্নতাকে কবিতার মায়াজালে তিনি বাঙ্‌ময় করে রেখেছেন তাঁর পাঠকের জন্য। আর রানী চন্দ ‘আমি তো তার কালো ছেলে’ বলা রবীন্দ্রনাথের অভিমানকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ঘরোয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি এঁকে। মাকে নিয়ে তাঁর কোনো স্মৃতিই কি নেই? আছে। তবে খুবই অল্প।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদাসুন্দরী দেবী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদাসুন্দরী দেবী

‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে একবার ইংরেজরা ছড়িয়ে দেয়, রাশিয়া ইন্ডিয়া আক্রমণ করছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বাবা তখন হিমালয়ে। ইংরেজদের ছড়ানো প্রপাগান্ডায় ভয় পেয়ে তাঁর মা সারদা দেবী রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে হিমালয়ে ‘কর্তাবাবু’কে একটি চিঠি লিখতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। তার উত্তরও এসেছিল যথাসময়ে। ঘনিষ্ঠতার চিত্র এটুকুই। তা ছাড়া সবই দূর থেকে দেখা গল্প। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, তাঁর মা আছেন। সেই মা অন্তঃপুরবাসিনী।

মা সারদাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর ভাইবোনদের এই দূরত্বের কারণ কী? এর উত্তর খুঁজতে হবে সেকালের অভিজাত মানুষদের সামাজিক বাস্তবতায়, পারিবারিক প্রথা আর বনেদিয়ানার নিগঢ়ে বাঁধা নারীজীবনের গল্পে। সরলা দেবী তাঁর স্মৃতিকথা ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন, ‘সে কালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল৷ শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত৷ ভূমিষ্ঠ হওয়ামাত্র মায়ের কোল ছাড়া হয়ে তারা এক একটি দুগ্ধদাত্রী দাই ও এক একটি পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হস্তে ন্যস্ত হত, মায়ের সঙ্গে তাদের আর সম্পর্ক থাকত না৷’ রবীন্দ্রনাথও জন্মের পর দস্তুরমতো দাই এবং পর্যবেক্ষণকারী পরিচারিকার হাতেই বড় হয়েছেন। কিছুটা বড় হবার পর চলে গেছেন ভৃত্যমহলে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘… ভৃত্যদের উপরে আমাদের সম্পূর্ণ ভার পড়িয়াছিলো। সম্পূর্ণ ভার জিনিসটা বড়ো অসহ্য। পরমাত্মীয়ের পক্ষেও দুর্বহ।’ (জীবনস্মৃতি) জোড়াসাঁকোর সন্তানেরা এই ‘দুর্বহ’ শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, ঠাকুর পরিবারের প্রায় সব সন্তানই বড় হয়েছেন তাঁদের মায়েদের ছাড়া। আর এ কারণে ঠাকুর পরিবারের পুরুষদের স্মৃতি যেভাবে পাওয়া যায়, প্রতিভাময়ী নারীরা ছাড়া অন্যান্য নারীকে তেমনভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না কোনো লেখায়, স্মৃতিকথায়।

শৈশবে রবীন্দ্রনাথ যখন ভৃত্যমহলে এক ভীতিকর, বিষণ্ন সময় কাটিয়ে বড় হচ্ছেন, তখন তাঁর মা সারদা দেবীকেও অন্তঃপুরের নারীমহলে সন্তান ছাড়াই বিষণ্ন সময় পার করতে হচ্ছে তাস খেলে। রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও কি অভিমান হতো সন্তানদের ছাড়া সময় কাটাতে? এর কোনো উত্তর আমরা জানি না। শুধু জানি, জীবনের শেষ প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ‘তাই তো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না’ বলে অভিমানে সজল হয়েছিলেন।