মা মানে মা

মা ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে মেয়ে ত্রপা মজুমদার
মা ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে মেয়ে ত্রপা মজুমদার

পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক আমার মা ফেরদৌসী মজুমদার। তবে পেশা বললে সচরাচর আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে নয়, মা পুরোপুরি ভালোবেসে আজ অবধি চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর এই কাজ। আর নেশা? সে কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? অবশ্যই অভিনয়-নাটক-থিয়েটার। আমার জন্ম হয়েছে থিয়েটারের আবহে। যেখানে মাকে দেখেছি সকালে স্কুল আর সন্ধ্যায় থিয়েটার করতে; কখনো টেলিভিশন নাটক। তাহলে এই সকাল-সন্ধ্যার ব্যস্ততায় আমার জন্য সময় কোথায়? সত্যি বলব? বাকি সময় পুরোটাই আমার। কাজের বাইরে বেড়ানো, আড্ডা, নিমন্ত্রণ—এসবে মা 

কোনো দিন শামিল হননি শুধু আমার কথা ভেবে, আমাকে সময় দেবেন বলে।

ছাত্রজীবনে আমার গৃহশিক্ষক বলতে ছিলেন অঙ্ক আর বিজ্ঞান বিষয়ের। বাকি সব কটি বিষয় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মা-ই আমাকে পড়িয়েছেন। একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে বন্ধু হিসেবেও মাকেই আমি সবার আগে, সবচেয়ে বেশি করে পেয়েছি। কোনো দিন কিছু গোপন করার প্রয়োজন হয়নি। স্বাধীনতা পেয়েছি অবাধ। নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। তবে স্বাধীনতা পেয়েছি বলে দায়িত্ববোধের সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই, তখন সবাই আপত্তি জানালেও মা-ই একমাত্র বলেছিলেন, ‘ওর ইচ্ছে না করলে করার দরকার নেই।’

কর্মজীবী মায়েদের সম্পর্কে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, তাঁরা সন্তানদের যথাযথ সময় দিতে পারেন না। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু উল্টো কথা বলে। মা বাইরে কাজ করেন বলেই অত্যন্ত সচেতনভাবে তিনি চেষ্টা করেন সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে, তার সঙ্গে ‘মানসম্পন্ন’ সময় কাটাতে। তবে এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়—এক, মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক এমন হতে হবে, যেখানে বোঝাপড়ায় কোনো ঘাটতি থাকবে না। অর্থাৎ, মা সন্তানের মন বুঝবেন, প্রয়োজন বুঝবেন; আবার সন্তান বুঝবে মাকে। অর্থাৎ মায়ের কাজটা যে মায়ের জন্য জরুরি, সেটা আর্থিক হোক বা মনের খোরাক জোগানোর জন্যই হোক, সেটা সন্তানকে বোঝাতে হবে। দুই, পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কাম্য। আমার মা সারা রাত কখনোই শুটিং করতে পারতেন না, যদি না আমার বাবা আমার পাশে থাকতেন। একইভাবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমি বিদেশে নাটক করতে চলে যেতে পারতাম না, যদি না আমার স্বামী আমার ১৩ বছরের কন্যাটিকে আগলে রাখতেন।

আমার মাকে আমি যেভাবে পেয়েছি, আমার মা যদি কর্মজীবী না হতেন, তাহলে হয়তো এতটা বেশি করে আমার তাঁকে পাওয়া হতো না—এটা নিতান্তই আমার ধারণা। একটা ছোট্ট গল্প দিয়ে শেষ করি। আমার মা সূর্য দীঘল বাড়ী চলচ্চিত্রটিতে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শুধু আমি ছোট ছিলাম আর আমাকে রেখে চলচ্চিত্রে দীর্ঘ সময় তিনি দিতে পারবেন না এই ভাবনা থেকে। এ নিয়ে আজও আমার মনে আক্ষেপের শেষ না থাকলেও মায়ের কিন্তু কোনো আক্ষেপ নেই। অদ্ভুত! এ জন্যই বোধ হয় বলে, মা মা-ই। এর কোনো তুলনা হয় না, বিকল্প হয় না।

লেখক: অভিনেত্রী এবং এক্সপ্রেশনস লিমিটেডের ক্রিয়েটিভ ও এক্সপ্রেশন সোশ্যালের প্রধান।