স্মৃতিময় মেটলাইফ

অলঙ্করণ: আরাফাত করিম
মেটলাইফের অমলকান্তিরা হৃদয়ে থেকে যায় পরম যত্নে, মমতায়। অলংকরণ: আরাফাত করিম
মেটলাইফের অমলকান্তিরা হৃদয়ে থেকে যায় পরম যত্নে, মমতায়। অলংকরণ: আরাফাত করিম

ক্ষান্তবর্ষণ কাকডাকা বিকেলে জাম আর জামরুলের পাতায় ‘অল্প-একটু হাসির মতন’ লেগে থাকা রোদ্দুর হতে চেয়েছিল যে অমলকান্তি, তার কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অমলকান্তি পেশাজীবনে পৌঁছে অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করত। কবিতার লাইনে স্কুলমেটের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর কঠিন বাস্তবতার কথা তুলে এনেছিলেন কবি। তবে যারা কবিতা লিখতে পারি না, গান গাইতে পারি না, ছবি আঁকতে পারি না, তারা? তাদেরও কি মনে পড়ে না মেটলাইফের মানুষদের?

ধানের ওপর হিরের টুকরোর মতো শিশির দেখতে দেখতে কিংবা বিষণ্ন দুপুরে ধূসর আলো গায়ে মেখে চলতে থাকা লোকাল বাস দেখতে দেখতে আমাদের মনেও অমলকান্তির মতো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হল কিংবা মেসমেটদের কথা মনে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা মেটলাইফের যাদের সঙ্গে এখনো আমাদের যোগাযোগ আছে, তাদের কাছে খোঁজ করি হঠাৎ মনে পড়া আমাদের অমলকান্তিদের কথা—কেমন আছে? কী করছে? কখনো এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, কখনো যায় না। কিন্তু আমাদের মেটলাইফের অমলকান্তিরা আমাদের হৃদয়ে থেকে যায় পরম যত্নে, মমতায়।

মেট (Mate) শব্দটির অনেক অর্থের মধ্যে একটি হচ্ছে বন্ধু। এক ক্লাসে, এক প্রতিষ্ঠানে, কোনো একটি বিশেষ জায়গায় একসঙ্গে স্বল্প বা দীর্ঘকালীন মেয়াদে থাকা কিছু মানুষের পারস্পরিক যে মিথস্ক্রিয়া, সেটাই মেটলাইফ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই জীবনের সাধারণ সম্বোধনসূচক শব্দগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো স্কুলমেট, কলেজমেট, ভার্সিটিমেট, হলমেট, ব্যাচমেট, মেসমেট, ইয়ারমেট, ক্লাসমেট।

আমরা যারা লেখাপড়া করি বা শেষ করেছি, যারা চাকরিসূত্রে বাড়ির বাইরে বসবাস করি, তাদের জীবনে মেট শব্দটি বিশেষ মহিমাময়। এই মেটলাইফের শুরু স্কুল থেকে—স্কুলমেট হিসেবে। চার-পাঁচ বছর বয়সে আমরা যখন স্কুলে যাতায়াত শুরু করি, তখনই আমাদের একগাদা স্কুলমেট এবং সেই সূত্রে ক্লাসমেট জুটে যায়। এই ক্লাসমেটরা শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন অধ্যায়েই পরিবর্তিত হতে থাকে কলেজমেট থেকে ভার্সিটিমেটে। ভার্সিটিতে এসে আরও নতুন ‘মেট’ যোগ হয় জীবনে। তৈরি হয় ইয়ারমেট, হলমেট, মেসমেট, রুমমেট। এই মেটদের সঙ্গে কেটে যায় জীবনের অনেকখানি সময়। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধু যোগ হয়। সেসব অভিজ্ঞতাই বেশির ভাগ সময় আমাদের জীবনবাস্তবতা মোকাবিলার কোরামিন হয়ে ওঠে।

মেটলাইফের শুরুটা হয় স্কুল থেকে। স্কুলের বেশির ভাগ মেট পরবর্তী জীবনে নাও থাকতে পারে বিভিন্ন কারণে। স্কুলমেটদের স্মৃতিও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঝাপসা হয়ে যায় সবচেয়ে বেশি। প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুলের যে মেটলাইফ, সেটার কিছু স্মৃতি থেকে যায় হয়তো। এর কারণ বোধ হয় বয়স। এই সময়টায় মানুষ প্রাকৃতিক কারণেই ‘ভিন্ন কিছু’ খুঁজে ফেরে। ‘ভিন্ন কিছু’র খোঁজ করতে গিয়ে যারা একসঙ্গে থাকে, তাদের স্মৃতিই থেকে যায়। বাকিরা ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যায় ধীরে ধীরে। তবে কলেজলাইফ একেবারে অন্য রকম। এ সময় স্কুলপড়ুয়া মেটরা প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্ক হতে শুরু করে। একটা অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয় জীবনে। নিষিদ্ধ কৌতূহল, বাউন্ডুলেপনা, প্রেম-বিরহ, রাজনীতি, সামাজিক বিধিনিষেধ ভেঙে ফেলা বা সেসব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মানসিকতা ইত্যাকার জটিল ও মানবিক বিষয়গুলো কমবেশি কলেজ থেকেই শুরু হয়। সঙ্গে শুরু হয় শরীরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন—যদিও সেটা স্কুলের ওপর ক্লাসে থাকতেই শুরু হয়। এসব বিভিন্ন কারণে কলেজমেটরা স্মৃতিতে থেকে যায় দীর্ঘসময়। এই সময়েই শুরু হয় হল/হোস্টেল বা মেসজীবন। সদ্য কলেজে ওঠা একটি ছেলে কিংবা মেয়ের পরিবার থেকে দূরে, একা একা থাকার যে মানসিক চাপ, সেটাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে এই হলমেট বা মেসমেটরা। যেহেতু পরিবারের বাধা এখানে অনুপস্থিত, তাই নিজেদের স্বাধীন ভাবতে শুরু করে সবাই। কাজেই এই সময়টা যেমন নতুন পত্রপল্লবে ভরে ওঠার সময়, তেমনি অতল পিচ্ছিল পথে গড়িয়ে যাওয়ারও সময় বটে।

মেটলাইফের প্রকৃত সময় আসলে কলেজমেটদের হাতে শুরু হয়। এ সময় বেশির ভাগ ছাত্রের পরিবার থেকে দূরে থাকার স্বাধীনতা এবং নগদ টাকা দুটোই হাতে থাকে। এ কারণে জীবন একেবারে অন্য রকম হয়ে ওঠে। লাজুকতা ভেঙে চপলতা বাড়ে, নতুন অভিজ্ঞতার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। যারা বাড়িতে থাকে, তাদেরও এই সময় মেটদের সঙ্গে চলাফেরার অনুমতি থাকে, অনুমতি থাকে বাড়ির বাইরে থাকার। সে এক রোমাঞ্চকর জগৎ, ভিন্ন গল্প।

কলেজ ফুরোলে আরও বড় জগৎ। বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ডাক্তারি পড়া হবে, ইঞ্জিনিয়ার নাকি মনোবিদ হবে, সাহিত্য-সংগীত নাকি সাংবাদিকতা, নাকি বিবিএ! কোনটা? এই জটিল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের প্রভাব যেমন থাকে, তেমনি থাকে মেটলাইফের ভূমিকা। মেটলাইফের ‘বড় ভাই/আপু’রা এ ক্ষেত্রে বড় সহায় হয়ে যান। অবশেষে পছন্দ বা অপছন্দ মতো যখন জীবন কিছুটা ‘সেট’, তখন শুরু হয় আরও বড় একটা মেটলাইফ। এ পর্বের বৈচিত্র্য আরও বেশি, পরিধি আরও ব্যাপক। এখানে পাওয়া যায় ‘সিনিয়র’, ‘জুনিয়র’ আর ‘সেম’—এই তিন ধরনের মেট। এই তিন ধরনের মেট তিন ধরনের প্রভাব ফেলে যায় জীবনে। জ্যেষ্ঠরা সুবুদ্ধি-কুবুদ্ধি দুটোই জোগান। কনিষ্ঠরা সহায়তা করে। আর সমবয়সীরা সঙ্গ দেয়। অনেক ধরনের সম্পর্কের আবরণ তৈরি হয় এই মেটলাইফে। কারও সঙ্গে ক্লাসের নোটের আদান-প্রদান সম্পর্ক, কারও কাছে বেপাড়ার খবর, কেউ রাজনৈতিক গুরু তো কেউ ‘জীবন ক্যামনে চালাবা মিয়া’ বলা জীবনমুখী দীক্ষাগুরু।

স্কুলে যা পড়ানো হয় না কিংবা কলেজে যা শেখানো হয় না, মেটলাইফ আসলে তা–ই শেখায়। ভীষণ গতিময় এ জীবন। কীভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় অথবা কতভাবে জীবনকে দেখা যায়, এ যেন তারই এক জীবন্ত মহড়া! এভাবে পার হয়ে যায় সময়। শুরু হয় জীবনের রশি ধরে ঝুলে থাকা বা তড়তড় করে ওপরে ওঠার ঘর্মাক্ত অধ্যায়। এই অধ্যায়ে কখনো কখনো মেটলাইফের মানুষেরাই উদ্ধারকর্তা হয়ে ওঠে বিভিন্নভাবে। এ পর্বে মেটলাইফের পরিধি বেড়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় মুখ্য হয়ে ওঠে। যেমন: রাবিয়ান, ঢাবিয়ান, বুয়েটিয়ান, চুয়েটিয়ান, জাবিয়ান ইত্যাদি। এই পরিচিতিগুলো মেটলাইফের ‘আফটার ইফেক্ট’।

মেটলাইফে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি ও উপলব্ধি থাকে, থাকে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, ব্যক্তিগত বন্ধুবৃত্ত। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করেই এগুলো গড়ে ওঠে। মেটলাইফের এই সম্পর্ক কারও কারও গড়িয়ে যায় জীবনভর, কারওবা ক্ষণস্থায়ী হয়। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন, একটি কথা তাঁদের মুখে মুখে ফেরে—ক্যাম্পাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বড়জোর তিন বছরের। এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু ক্যাম্পাসজীবনে শুরু হওয়া মেটলাইফের স্মৃতি সারা জীবনের—তা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ থাক আর না থাক।