পরীক্ষার ফলাফল মনের মতো হয়নি

পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না হলে সন্তানের প্রতি দেখাতে হবে সহমর্মিতা। মডেল: ছাইফুল ইসলাম ও ইয়াস জোয়ারদার। ছবি: কবির হোসেন
পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না হলে সন্তানের প্রতি দেখাতে হবে সহমর্মিতা। মডেল: ছাইফুল ইসলাম ও ইয়াস জোয়ারদার। ছবি: কবির হোসেন

মাইশার (ছদ্মনাম) পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। সে যেমনটা ভেবেছিল বা তার বাবা–মা যেমনটা ভেবেছিলেন, ফল তেমনটা হয়নি। তার যতটা মন খারাপ তার বাবা-মায়ের মন তারচেয়ে বেশি খারাপ। মা তো প্রায় শয্যাশায়ী আর বাবা মুখ গম্ভীর করে টিভি দেখছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। বাবা–মায়ের অবস্থা দেখে মাইশা আরও ভেঙে পড়ল। কোথায় বাবা–মা তাঁকে সান্ত্বনা দেবেন, তা না উল্টো উনারাই মুষড়ে পড়েছেন।

সন্তানের ফল মনমতো না হলে মা-বাবারা মন খারাপ করেই থাকেন। তবে মন খারাপের প্রতিক্রিয়া যদি গঠনমূলক না হয়, তবে সন্তানের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং ভবিষ্যতে আরও খারাপ রেজাল্ট করার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পরীক্ষার ফল নিয়ে মা–বাবারা একটা প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন। ‘ইশ্​ আমার ছেলে যদি জিপিএ–৫ না পায় মুখ দেখাব কী করে’ বা ‘আমার কলিগের মেয়ে পুরস্কার পেয়েছে আর তুমি মাত্র দুই বিষয়ে এ প্লাস?’ এভাবে তাঁরা সন্তানের মানসিক শক্তিকে আরও কমিয়ে দেন, সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর প্রয়াসকে থামিয়ে দেন। সন্তানের পরীক্ষার ফল প্রত্যাশিত মানের চেয়ে খারাপ হতে পারে। পরীক্ষার প্রস্তুতি, খাতায় উপস্থাপনা এমনকি পরীক্ষকের মান ইত্যাদি বিষয় ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, প্রস্তুতি ভালো না থাকায় প্রত্যাশিত ফল হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও পরীক্ষার দিন যথাযথভাবে পরীক্ষা দিতে না পারা এবং পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণে ফল আশানুরূপ না-ও হতে পারে। পরীক্ষার ফল প্রত্যাশিত না হলে পরীক্ষার্থীর বাবা-মা নানা প্রতিক্রিয়া দেখান। এই প্রতিক্রিয়া যদি ইতিবাচক হয়, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক। আর নেতিবাচক হলে তা ক্ষতিকর। সন্তানের বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই তাকে মূল্যায়িত হতে হয়—এই মূল্যায়ন–প্রক্রিয়ায় তাকে উৎসাহিত করা না হলে তার মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হতে পারে, নিজের ওপর থেকে আস্থা চলে যেতে পারে। ছেলে বা মেয়েটির তখন মনে হতে পারে, ‘আমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’

আবার অভিভাবকদের মনে রাখতে হবে যে সফলতার মতো ব্যর্থতাও জীবনের একটি অনুষঙ্গ। ফলে ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মতো তৈরি করতে হবে সন্তানকে। জীবনে সফলতার অর্থ কেবল পরীক্ষায় ভালো ফল নয়, বরং সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে সামাজিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করা হাজার গুণ জরুরি। তাই সন্তানের পরীক্ষার ফল প্রত্যাশিত না হলে ভেঙে পড়বেন না, সন্তানের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবেন না বরং তার যেটুকু অর্জন হয়েছে সেটাকে উৎসাহিত করুন, যাতে সে ভবিষ্যতে আরও ভালো করতে পারে। এ জন্য প্রত্যাশিত ফল না করা পরীক্ষার্থীর বাবা-মায়েরা যা যা করতে পারেন:

● কেন এই রেজাল্ট: এই অপ্রত্যাশিত ফল কেন হলো তা বোঝার চেষ্টা করুন ও সমাধানের ব্যবস্থা নিন। শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা, মা-বাবার মধ্যে তীব্র দাম্পত্য কলহ, স্কুলের সহপাঠী বা শিক্ষক দ্বারা উত্ত্যক্ত হওয়া, কারও সঙ্গে আবেগের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার মতো বিষয় আছে কি না, খুঁজে দেখুন।

● ধৈর্য হারাবেন না: মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ভিগাস মিলার তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে বলেছেন, ‘চিৎকার করা, ধমক দেওয়া বা উপদেশ কোনো ভালো ফল আনে না, তাই শান্ত থাকুন।’ তিনি এ-ও বলেন যে ভালো ফলের জন্য বড় পুরস্কার যেমন কোনো উপকারী নয়, তেমনি খারাপ ফলের জন্য তিরস্কার কোনো সুফল আনে না।

● সন্তানের যত্ন নিন: প্রত্যাশিত ফল না হওয়ায় সে-ও ভেঙে পড়েছে। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। তার পাশে বন্ধুর মতো থাকুন।

● কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না: সন্তানের ফলাফল যেমনই হোক না কেন, তাকে অন্য কারও সঙ্গে তুলনা করবেন না।

● কটূক্তি বা ব্যঙ্গ নয়: ফলাফলের জন্য তাকে কটূক্তি, ব্যঙ্গ ইত্যাদি করা যাবে না। শারীরিক নির্যাতন করবেন না। তার অবসর যাপনের ক্ষেত্রগুলোকে বন্ধ করবেন না। ঘরে আটকে রাখবেন না।

● উৎসাহ দিন: সন্তানের ফলাফল আপনার মনমতো না হলেও তাকে উৎসাহ দিয়ে যান। ফলাফল যেমনই হোক না কেন তাকে ফলাফল উপলক্ষে ছোটখাটো উপহার দিন বা পছন্দের খাবার খেতে দিন।

● শিক্ষকের দোষারোপ নয়: ফলাফলের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করবেন না। সন্তানের সামনে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকের সমালোচনা করবেন না।

● নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না: সন্তানের ফল আশানুরূপ না হলে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। লুকিয়ে থাকবেন না। বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা করুন। তাতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

● প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ: অনেক সময় মানসিক রোগ, সেলফোন বা ইন্টারনেট আসক্তি এবং মাদকাসক্তির কারণে সন্তানের পরীক্ষার ফল আশানুরূপ নাও হতে পারে। এ ধরনের ইস্যু থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।