নগরবাসীর ইফতার-সাহ্রি

>

ঘরের বাইরে ইফতারি খাওয়ার চল এখন বেশ দেখা যায়। মডেল: সারাকা ও অভি, ছবি: সুমন ইউসুফ, স্থান: ন্যানদো’স
ঘরের বাইরে ইফতারি খাওয়ার চল এখন বেশ দেখা যায়। মডেল: সারাকা ও অভি, ছবি: সুমন ইউসুফ, স্থান: ন্যানদো’স

ঘরের খাবার তো আছেই, তারপরও কখনো স্বাদ বদলাতে, কখনো পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে, কখনোবা আনুষ্ঠানিক আয়োজনে বাইরে ইফতার করাটা এখন নগর সংস্কৃতির অংশই হয়ে উঠেছে। সাহ্​রির বেলাতেও এমন ধারা দেখা যাচ্ছে বছর কয়েক ধরে। ইফতার ও সাহ্​রি ঘিরে নগরবাসীর জীবনযাপনে যোগ হয়েছে নতুন ধারা। লিখেছেন গাউসুল আলম শাওন

রমজান মাসের ইফতার ও সাহ্​রির সময়কে ঘিরে গত কয়েক বছরে খাবারদাবারে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। একদিকে প্রতিদিন বড় হতে থাকা ইফতারের আয়োজন, আরেক দিকে বড় হচ্ছে সাহ্​রি অ্যাডভেঞ্চার। ঘরোয়া আয়োজনের পাশাপাশি বাইরে হোটেল–রেস্তোরাঁয় ইফতার ও সাহ্​রি করার নতুন নাগরিক এক সংস্কৃতিও দেখা যাচ্ছে।

ঐতিহ্যবাহী কিংবা প্রথাগত ইফতারির পাশাপাশি লোকে এখন নতুন নতুন পদ নিয়ে ইফতারের খাবার তালিকায় পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাচ্ছে। তাই তো জাপানি কিংবা চীনা খাবারের রেস্তোরাঁতেও ইফতারি বুফের ভিড়। কোনো দিন শুনবেন, লোকে চীনা রেস্তোরাঁয় বসে ছোলা চাওমিন দিয়ে ইফতার করছে, ফিউশন এসে ইফতারের বাজারে নাক ঢোকাল বলে। তাই বলে ভালো পেঁয়াজি, মুচমুচে বেগুনি কিংবা মনভোলানো হালিমের খোঁজ কিন্তু একটুও কমেনি। কিন্তু পাচ্ছি কই বলুন?

রোজা এলেই শুরু হয়ে যায়, ‘না! সেই হালিমটা পাচ্ছি না’। ব্যস শুরু হয়ে গেল হালিমের খোঁজ। ‘প্রিয় সেই হালিম, তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’। কিন্তু সেই হালিম আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নানাজনের পরামর্শমতো প্রতিদিন নতুন নতুন দোকান থেকে হালিম আসছে, কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। কোনোটায় ডালের মহাসাগরে মাংসের খোঁজ, কোনোটায় গন্ধ বেশি, কোনোটা দেখলে আবার মনে হয়, এটা কি হালিম? আমার অবশ্য বেগুনির ব্যাপারে ভীষণ দুর্বলতা। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই পাঁচ তারকা হোটেলের করপোরেট ইফতারের টেবিলে সাজানো ঠান্ডা চিমসানো বেগুনি নামের প্রহসন হলে চলবে না। একদম বাড়িতে বানানো মায়ের হাতের গরম-গরম মুচমুচে ফুলকো বেগুনি হতে হবে। আহ্​, মুখে পড়তেই ম্যাজিক, চোখ দুটো কখন যে বন্ধ হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না।

ইফতারির পদ নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চললেও সাহ্‌রির খাবারে ঐতিহ্যবাহী ধারা এগিয়ে। মডেল: ইভা ও রিমন, স্থান: স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট
ইফতারির পদ নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চললেও সাহ্‌রির খাবারে ঐতিহ্যবাহী ধারা এগিয়ে। মডেল: ইভা ও রিমন, স্থান: স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট

একই কথা পেঁয়াজির ক্ষেত্রেও সত্য। বলার মানে হচ্ছে, এত দিনের পোড়খাওয়া মুখ আর জিহ্বাকে পেঁয়াজির নামে কেউ ডাল বড়া খাইয়ে দেবে, তা চলবে না। এই মুখ, এই জিহ্বা পেঁয়াজি চেনে। কিন্তু সে–ও আজকাল বাজারে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে আর রোজার মাস এলে তো কথাই নেই। তাই তো পেঁয়াজির জায়গায় ডাল বড়া, বেগুনির জায়গায় পেঁপেনি আর হালিমের জায়গায় সেলিম। কিন্তু আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে ভালো পেঁয়াজি, মুচমুচে ফুলকো বেগুনি কিংবা মাংসে ভরা হালিমের জন্য।

ছোটবেলায় আমার কাছে সাহ্​রি মানেই ছিল মায়ের হাতে মাখিয়ে দেওয়া দুধ–কলা দিয়ে ভাত। এখন এসব নস্টালজিয়া নিয়ে কথা বলে লাভ নেই, এখন হচ্ছে সাহ্​রি পার্টির যুগ, আর বৃহস্পতিবার হলে তো কথাই নেই। তবে সাহ্​রির ব্যাপারে জনতা এখনো প্রথাগত খাবারদাবারের জগতেই ঘোরাফেরা করছে। তাই তো আল-রাজ্জাক কিংবা স্টার হোটেলে সাহ্​রির সময় এত ভিড়। তবে একটা বড় অংশের মানুষ কিন্তু এখনো এক গ্লাস দুধ কিংবা একটা কলা এক গ্লাস দুধে চটজলদি সাহ্​রি সেরে নেয়। এই পাগলা ভিড়ের শহরে সাহ্​রির সময় ফাঁকা রাস্তায় বেরিয়ে শহরটাকে নতুন করে আবিষ্কার করতেও মন্দ লাগে না। চিরচেনা শহরও কেমন অচেনা মনে হয়। ঘুম ঘুম চোখে ঘোরের মধ্যেই মুখের ভেতর চালান হয়ে যাচ্ছে আল-রাজ্জাকের মাটন গ্লাসি, আহা!

আসলে কথা হচ্ছে, ভালো খাবারের জন্য বাঙালি যা খুশি তা–ই করতে রাজি। সে এখন শহরজুড়ে ঘুরে ঘুরে হন্যে হয়ে হালিম খোঁজা হোক, নতুন স্বাদের জন্য ছোলা চাওমিন ট্রাই করা হোক কিংবা মাঝরাতে উঠে আল-রাজ্জাকের মাটন গ্লাসি খাওয়া হোক। তবে আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ হওয়ায় সাহ্​রি নিয়ে হইচইটা এত বেশি। তারুণ্যের উৎসাহ এবং উত্তেজনা দুটোই বয়স্কদের চেয়ে অনেক বেশি আর তাই তারাই কিন্তু আজ এই সাহ্​রি নাইটের হইচইয়ের কান্ডারি। তা হোক, তরুণেরা তাদের নিজেদের মতো করে নিজেদের সময়ের গল্পগুলো তৈরি করুক, সেটাই ভালো। সেই গল্পগুলোর সঙ্গে আমাদের পুরোনো গল্পগুলোও একটু করে থাকুক। কারণ নতুন গল্প তো আর একা পথ চলে না, সঙ্গে পুরোনো গল্পগুলোও জুড়ে থাকে নতুন গল্পের জমিন হিসেবে। অন্তত ইতিহাস তো সেই কথাই বলে।

লেখক: গ্রে অ্যাডভার্টাইজিংয়ের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ও কান্ট্রি হেড