এক ঈদে, সিলেট অঞ্চলে

নিরিবিলি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: পল্লব মোহাইমেন
নিরিবিলি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ছবি: পল্লব মোহাইমেন

এক পরিবারের বসবাস ঢাকায়, আরেক পরিবারের খুলনায়। একসঙ্গে ঈদ করা হয়ে ওঠেনি অনেক বছর। সেই যে যখন পড়াশোনার জন্য রাশিয়ায় কাটাতে হয়েছে জীবনের বড় একটা সময়, তখন কয়েকটি ঈদ চারজন মিলে একসঙ্গে করা গেছে। দেশে এসে এক দম্পতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিপ্রযুক্তি পড়াতে পড়াতে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন, ঢাকার দুজন চিকিৎসক আর সাংবাদিক, চাকরি করতে করতে গলদঘর্ম। তাই কোথাও না কোথাও যেতে হবে সবাই মিলে—আন্ডাবাচ্চাসহ, যেন একটু তাজা বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া যায়, আর আগের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণায় মুখর হওয়া যায়।

হ্যাঁ, ঈদের সময় ঢাকা শহর অনেকটাই ফাঁকা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কি নয়নাভিরাম, হৃদয়হরণ করা জায়গার অভাব পড়েছে? সিদ্ধান্ত হয় মৌলভীবাজারে যাওয়া হবে।

রোজার সময় মাইক্রোবাস ভাড়া করার ঝক্কি অনেক। আকাশচুম্বী ভাড়া হাঁকতে পারে রেন্ট-এ কার কোম্পানি। কিন্তু একজন পরিচিত বেরিয়ে গেল, যিনি সহনক্ষমতার মধ্যেই একটি মাইক্রোবাস জোগাড় করে দিলেন। চালকের সঙ্গে আমরা দ্রুত বন্ধুত্ব করে নিলাম এবং তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা আসলে কোনো মোটরগাড়ির প্রতিযোগিতায় যাচ্ছি না। গরুর গাড়ির চেয়ে একটু বেশি গতিতে মাইক্রো চালালেই হবে। আমাদের গন্তব্য মৌলভীবাজারের শমশেরনগরের একটি রিসোর্ট, কোনো কারণেই তা আকাশ অভিমুখী নয়। তাই ধীরে ধীরে সেদিকে এগোলেই চলবে।

গত বছর রমজান মাস শেষ হওয়ার দুদিন আগে ছিল আমাদের এই সফর। যাঁরা ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়ি যান, তাঁরা জানেন পথেঘাটে কী বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। চার ঘণ্টার ভ্রমণ শেষ করতে হয়েছে ২৪ ঘণ্টায়, এ রকম অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। সিলেট অঞ্চল ভ্রমণের জন্য বেছে নেওয়ার এটাও ছিল কারণ। জানা ছিল, এই পথে যানজট হয় কম।

গত বছর ঈদের সময় দেশের নদীগুলো একটু বেয়াড়া আচরণ করছিল। সিলেট অঞ্চলেও তাদের মেজাজ ছিল খারাপ। বেশ উন্মত্ত হয়ে স্বাগত জানাল ধলাই। শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়ে শমশেরনগরের দিকে যাওয়ার পথে একঝলক দেখা গিয়েছিল তাকে। ধলাইয়ের কথা আবার আসবে পরে, সেটা মনে রাখুন।

মৌলভীবাজার নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁরা সবাই জানেন, ছোট–বড় টিলা, চা–বাগান আর খরস্রোতা নদী এই এলাকাটিকে করে তুলেছে মোহনীয়। এই জেলায় ঢুকে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হবে যান্ত্রিক জীবন থেকে আমরা এইমাত্র অবতরণ করলাম প্রকৃতির রানওয়েতে। আঁকাবাঁকা পথ, পথের দুধারে সবুজের সমারোহ দেখে মনে হতেই পারে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হতো শমশেরনগর বিমানবন্দরটি। তারই একপাশে সুইসভ্যালি রিসোর্টে আমরা পৌঁছে গেলাম বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে।

রিসোর্টে নীল জলের সুইমিংপুল টানছিল আমাদের। ঘরে জিনিসপত্তর রেখেই আমরা পৌঁছালাম সেখানে। কালো মেঘে ঢাকা আকাশের ছায়া এসে পড়ছিল জলে, সে জলেই দাপাদাপি করতে থাকল সাঁতার জানা ও না–জানা ছোট–বড়রা। সুইমিংপুলের পাশেই ছিল দোলনা। তাতে যখন ৫০ বছর বয়সের মাহতালাত আহমেদ দুলছিলেন, তখন মনেই হচ্ছিল না, তিনি একজন অধ্যাপক, মনে
হচ্ছিল সদ্য শৈশব থেকে জেগে ওঠা এক বালিকা–জীবনকে উপভোগ
করছে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, স্নান সেরে আমাদের প্রথম গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। কমলগঞ্জ আর শ্রীমঙ্গল উপজেলার কিছুটা নিয়ে এ উদ্যান। দলে কৈশোর পেরোনো তিন সদস্য। তারা লাউয়াছড়ার ছোট ছোট ছড়া, ট্রেইল, বিচিত্র গাছের সারি আর পশুপাখি দেখে আনন্দ পেল। বড়রা? তাঁরা হাঁটার সময় যুবকদের থেকে একটু পিছিয়ে থাকলেন, কিন্তু তাঁদের মনে থাকল অনাবিল আনন্দ।

মুখপোড়া হনুমান আর উল্লুকের নাকি দেখা পাওয়া যায় এই বনে। কিন্তু বেশ কয়েক রকম পাখি আর ছোটখাটো প্রাণী ছাড়া আর কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের।

মাইক্রোবাসে করে এরপর আমরা গেলাম মাধবপুর লেকে। চা–বাগানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অনুমতি নিয়ে ঢুকলাম। লেকের জলে পদ্মফুল! স্মার্টফোনের যুগে পদ্মরা না চাইতেই মডেল হয়ে উঠল। এরপর বিশাল সে লেকের এক পাশ দিয়ে পাহাড়ে ওঠা হলো। তখনো বৃষ্টি পড়েনি এক ফোঁটাও। আকাশ বলছে, ঝেড়ে কাশবে সময় হলে। আমরা যখন মাধবপুর লেকের পাহাড়ে ওঠার কথা ভাবছি, তখন এক বৃদ্ধ পাহাড়ি ভদ্রলোক এলেন।

তাঁর দেখাদেখি আরও দুজন চা–বাগানের শ্রমিক চলে এলেন। তিনজন মিলে শুরু করলেন গল্প। তাঁদের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে হিম হয়ে যেতে লাগল মন। সত্যিই কি মানুষের জীবনে এত সংগ্রাম থাকে? সত্যিই কি এক থালা ভাতের সঙ্গে শুকনো চায়ের পাতার তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া যায় দিনের পর দিন? ‘আর কিছু খান না?’ এ প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, চা–বাগানে কাজ করে তাঁরা কী পরিমাণ টাকা
আয় করেন এবং কীভাবে বেঁচে
থাকেন, তা।

রাতে আমরা রিসোর্টের লোভনীয় খাবার খাই। মুরগির মাংস, ডাল, সবজি এবং গ্রিল করা মুরগি দিয়ে ভাত খেতে মন্দ লাগেনি। রাতটা ছিল বৃষ্টির দখলে। রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ রকম বৃষ্টি উপভোগ করা একটা তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতাই বটে!

পরদিন অর্থাৎ ঈদের আগের দিন আমরা বেরিয়ে পড়ি সিলেট শহরের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার হয়ে লালাখালের উদ্দেশে। যাওয়ার সময়ই দেখেছিলাম, নদী যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। দলের সদস্য সনকা বলেছিল, স্যুটকেস, ব্যাগগুলো মাইক্রোতে উঠিয়ে নিতে। সেটা না করে যে ভুল করেছি, তা বুঝলাম পরে। অস্বীকার করব না, লালাখালে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু সেটা বলব অন্য জায়গায়। এখানে বলার মতো বিষয় হলো, রাত ৯টার দিকে যখন শ্রীমঙ্গল হয়ে শমশেরনগরের দিকে ফিরছি, তখন ফোনে বলে দিয়েছিলাম, আমরা রাতে কী কী খাব। খাবার রান্না হচ্ছিল রিসোর্টে। কিন্তু লাউয়াছড়া ছাড়ানোর পরই দেখতে পেলাম, সব গাড়ি ফিরে আসছে এদিকে। চেঁচিয়ে বলছে ওরা, ওদিকে যাবেন না, বন্যার পানি উঠে পড়েছে রাস্তার ওপর। কোথায় নদী, কোথায় রাস্তা ঠাওর করা যায় না। ধলাই তখন উন্মত্ত।

আমরা দাঁড়ালাম। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। রিসোর্ট থেকে ফোন এল, রান্না তৈরি। সার্ভ করবে কখন! তখন আমরা প্রথম আলোর মৌলভীবাজার প্রতিনিধিকে ফোন করে জানতে পারলাম, এই বন্যা ডিঙিয়ে সুইসভ্যালি রিসোর্টে পৌঁছানো যাবে না। ফলে শ্রীমঙ্গল ফিরে রাত ১২টার দিকে একটা রেস্তোরাঁয় আমরা খেলাম। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের কল্যাণে সে রাতে চা গবেষণা কেন্দ্রের রেস্টহাউসে জায়গা হলো আমাদের। রাত কাটল, এল ঈদের দিন। আমরা খুব সকালে নাশতা করে মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। ঈদের দিনটা কাটবে পথে পথে। ঢাকায় বন্ধু শিহাব আর কেয়া রান্না করছে। সেখানে গিয়ে খাব দুপুরের খাবার। আর আমাদের স্যুটকেস? সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হবে বাসে করে, বন্যার পানি কমলে।

আমাদের ভ্রমণটা ছিল এ রকম। কিন্তু একটা বন্য, প্রাকৃতিক মুক্তির স্বাদ যে আমরা পেয়েছি, তার প্রমাণ ছিল মাইক্রোচালকসহ আটজন মানুষের অবয়বে।