এটা এক নতুন জীবন

৮ মে ২০১৯—দ্বিতীয় জীবনের শুরু।

মিয়ানমার সময় আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিমান বাংলাদেশের ড্যাশ-৮ ইয়াঙ্গুন বিমানন্দরের রানওয়ের মাঝামাঝি এসে মাটি স্পর্শ করল। তারপর আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করলাম বিমানটি আবার বাতাসে ভেসে উঠল এবং ৩–৪ সেকেন্ড ভেসে থেকে আছড়ে পড়ল রানওয়েতে। প্রচণ্ড গতি নিয়ে ছিটকে পড়ল রানওয়ের শেষে মাটিতে। রানওয়ে ছোঁয়ার পর মাটিতে আছড়ে পড়ার পুরো ঘটনা ঘটে গেল মাত্র ১০–১২ সেকেন্ডের মধ্যে।

তারপর যা দেখলাম, যেন এক দুঃস্বপ্ন। বিমানের আসন এবং মাথার ওপরে থাকা লাগেজ কেবিনগুলো ভেঙে পড়েছে মেঝেতে। মুহূর্তের ঘটনায় বিমানের ভেতরটা মনে হচ্ছিল যেন জঞ্জালের স্তূপ। চিন্তা করার সময় খুব কম, প্রতিটি মাইক্রোসেকেন্ডেই আগুন লেগে যাওয়ার আতঙ্কে কাটছে। নিজের কোমরের আঘাতজনিত ব্যথা তখনো বুঝে উঠিনি। দ্রুত সবার আগে আমিই চলে এসেছি ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’ দরজার কাছে। হাতল ঘুরিয়ে দরজাটি আন-লক করতে সমর্থ হলাম কিন্তু একজন বিদেশি সহযাত্রীসহ দুজন মিলে শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়েও সেটা খুলতে পারলাম না। খোলা যাচ্ছিল না দরজাটি, কারণ বিমানটি লম্বালম্বিভাবে দুপাশে ভেঙে পড়ায় সব এক্সিট দরজা আটকে গিয়েছিল। শুরু হয়ে গেল ভয়ের দ্বিতীয় পর্যায়, এই বুঝি লেগে গেল আগুন।

শুরু হলো মানবিক অধ্যায়

আনুমানিক সাত–আট মিনিটের মধ্যে বিমানবন্দরের উদ্ধারকারী দল বিমানের দরজা কেটে বের করল সব যাত্রী, পাইলট ও ক্রুকে। যাত্রীদের কেউ কেউ একজন অপরজনকে সাহায্য করেছেন বের হয়ে আসতে। তিন টুকরো হয়ে যাওয়া বিমানের বাইরে তখন আঘাতপ্রাপ্ত যাত্রীদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। নানা দেশের নানা ভাষার মানুষ। বিমানবন্দরের অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাতে একটু বেশি সময়ই লেগেছিল। আহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন অসহ্য যন্ত্রণায়। স্বল্প আহত যাত্রীরা তখন গুরুতর আহত যাত্রীদের সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। একজন তাঁর হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে বের হতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই লাগেজ থেকে নিজের কাপড় বের করে এগিয়ে দেন নাকমুখ, শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে যাওয়া রক্তাক্ত যাত্রীদের।

বিমানবন্দর থেকে দ্রুততার সঙ্গে কোনো ইমিগ্রেশন চেকিং ছাড়াই আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের নর্থ ওক্কালাপা জেনারেল হাসপাতালে। ভাষাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে এয়ারপোর্ট অফিসার, স্টাফ থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্সের চালক এবং মেডিকেল অ্যাটেন্ড্যান্ট কাউকেই সহজে আমাদের কথা বোঝাতে পারছিলাম না। তবে আমাদের ব্যথা তাঁরা টের পাচ্ছিলেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্য করছিলেন। সীমিত সুবিধার এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছার পর ডাক্তার–নার্সদের আন্তরিকতা মনে থাকবে সারা জীবন।

ওক্কালাপা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরপরই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইয়াঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালে (মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল)। দুই ঘণ্টার মতো সময় ছিলাম এখানে। এই সময়ের মধ্যেই দারুণ দক্ষতা, পেশাদারি আর আন্তরিকতার সঙ্গে এই হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স এবং স্টাফরা সবাই মিলে আমাদের প্রাথমিক মূল চিকিৎসা দিয়ে দিলেন।

বাংলাদেশ বিমান এবং ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্তৃপক্ষ চাইছিল মিয়ানমারের সর্বোচ্চ সুবিধার হাসপাতালে যেন আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। মিয়ানমার সরকারের একজন মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের হাইকমিশনার উপস্থিত থেকে ইয়াঙ্গুনের আরইউ আন্তর্জাতিক হাসপাতালে সব রোগীকে স্থানান্তরকাজ তদারকি করেন।

স্থানীয় সময় রাত আড়াইটা নাগাদ আমরা সবাই স্থানান্তরিত হলাম আরইউ হাসপাতালের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তলায়। এখানকার প্রত্যেক চিকিৎসক, নার্সসহ সবাই আমাদের প্রতি ছিলেন দারুণ আন্তরিক। বাংলাদেশের সঙ্গে অস্থির রাজনৈতিক সম্পর্কের একটি দেশ বলে একটু দ্বন্দ্ব ছিল মনে, কিন্তু মিয়ানমারের এই হাসপাতালের কর্মীদের ব্যবহার আমাদের অভিভূত করেছে।

১০ মে হাসপাতাল ছাড়ার সময় সবাই মিলে আমাদের বিদায়ী উপহার দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে রোগী না বরং সুস্থ–স্বাভাবিক অবস্থায় হাসপাতালে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে ঢাকা ফেরার বিমান ধরতে আমাদের বিমানবন্দর–যাত্রাও ছিল মনে রাখার মতো। ৪৫ মিনিটের যাত্রায় আমাদের পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনে–পেছনে বিশেষ পাহারা তো ছিলই, আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে আমাদের গাড়িগুলোকে পার করে দেওয়া হয়।

এবার বলি সত্যিকারের আপন মানুষে পরিণত হওয়া মিয়ানমারপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ভালোবাসার কথা। মিয়ানমারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা কাজ করেন বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, এনজিও বা বড় প্রতিষ্ঠানে। কেউ–বা নিজের ব্যবসা পরিচালনা করেন। বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ামাত্রই ১৫–২০ জন দৌড়ে চলে আসেন মিয়ানমার জেনারেল হাসপাতালে। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আহত যাত্রীদের পাশে একেকজন দাঁড়িয়ে যান সঙ্গী হয়ে। তখন তাঁরাই আমাদের দোভাষী, তাঁরাই আমাদের পরম আত্মীয়। পরের দুই দিনও তাঁরা আমাদের পাশেই ছিলেন। বুঝতেই পারিনি আমাদের খুব কাছের কেউ আমাদের পাশে নেই। আহতদের জন্য খাবার রান্না করে আনা, স্থানীয় সিম কার্ড কিনে আনা, একসঙ্গে হাসপাতালে বসে ইফতার করা...ঢাকায় থাকলেও আমরা এর চেয়ে আর বেশি কী পেতাম! মেহেদি ভাই, সানি, নাজমুল, আয়েশা আপা, রায়হান ভাই, বাপ্পি, রিয়াজ, বিজন ভাইসহ সবার ভালোবাসায় এই নতুন জীবনের নতুন পাওয়া। হাসপাতাল ছাড়ার দিন আমরা সবাই যখন ঢাকায় আপনজনদের কাছে ফিরছিলাম, মিয়ানমারের এই ভাইবোনেরাও তখন আবেগে আপ্লুত। দুর্ঘটনার পরের সময়গুলো সবার সাহায্য ও ভালোবাসা আমাদের মানসিক ট্রমা দূর করতে টনিক হিসেবে কাজ করেছে।

নতুন এই জীবনের উপলব্ধি—পৃথিবীটা অনেক সুন্দর; তার চেয়েও সুন্দর এই পৃথিবীর মানুষেরা।

লেখক: উদ্যোক্তা এবং ক্লাস টিউন ও চ্যাম্পস টোয়েন্টি ওয়ানের প্রধান নির্বাহী