বরফযাত্রা

সিকিমের বরফ ঢাকা রাস্তা। ছবি: লেখক
সিকিমের বরফ ঢাকা রাস্তা। ছবি: লেখক

এপ্রিলের এক আগুনঝরা সন্ধ্যায় আমরা পাঁচজন ট্রেনে উঠেছিলাম। ঢাকা থেকে সেই ট্রেন শহর-নদী-দূরের সবুজ ফসলি খেত পেরিয়ে সকাল নয়টায় পৌঁছায় পঞ্চগড়। স্টেশন থেকে নেমেই পথ ধরি বাংলাবান্ধার। সীমান্ত পর্যন্ত এই পথটুকু অদ্ভুত সুন্দর, উত্তরবঙ্গের মানুষের মতোই যেন সরল। বাংলাবান্ধা সীমান্তে অভিবাসনের আনুষ্ঠানিকতায় এসে হলো ভয়াবহ তিক্ত অভিজ্ঞতা। সে মন খারাপ করা অভিজ্ঞতার রেশ মনে চেপেই পা রাখি ভারতের মাটিতে।

আমাদের গন্তব্য সিকিম। বরফের রাজ্য। সেখানে যেতে হলে শিলিগুড়ির সিকিম হাউস অথবা সিকিমের সীমান্ত রাংপো থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়। সে আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যেতেই আমাদের পাঁচজনের দলটা আটজনে রূপ নিল (খরচ বিবেচনায় সিকিম ঘোরার জন্য আটজনের দল হচ্ছে ‘উৎকৃষ্ট’)। একসময় দলেবলে বুনো ফুল ফোটা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢুকলাম বরফ দেশের সীমান্তে। ছয় ঘণ্টার যাত্রা শেষে সামনে হাতছানি দিল রূপকথার রাজ্য—গ্যাংটক।

পরদিন সকাল সকাল এমজি মার্গ, তাশি ভিউ পয়েন্ট, গণেশটক পয়েন্ট, ফ্লাওয়ার গার্ডেন, জ্যু থেকে শুরু করে নানা আশ্রম ঘুরে বরফ দেখার সব আয়োজন সেরে ফেললাম। সিকিমের চারটা জেলা; এর মধ্যে উত্তর সিকিম এবং পূর্ব সিকিমে যেতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। সেই অনুমতির জন্য ছয় কপি ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র লাগল। সে রাতে আমরা ঘুমালাম পাহাড়ের গায়ে মিটমিট করে জ্বলা অসংখ্য তারার সঙ্গে।

তারার মিছিল পেরিয়ে পরের দিন ঘুম ভাঙল মেঘের চাদরে। কনকনে ঠান্ডায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো প্রায় ৯ হাজার ৬০০ ফুট ওপরের শহর লাচুংয়ে। এখান থেকেই জিরো পয়েন্টে যাওয়ার পরিকল্পনা। জিরো পয়েন্ট মানেই বরফ, বরফ মানেই ছোট্টবেলার সেই স্বপ্ন পূরণ। লাচুং থেকে জিরো পয়েন্টের রাস্তাটা শীতকালে বরফ জমাট হয়ে বন্ধ হয়ে যায়, এপ্রিলের শেষ দিকে অনেকটা চলাচল উপযোগী থাকে। আমরা যাওয়ার তিন দিন আগেই খুলেছে সেই রাস্তা।

পাহাড়ের রাস্তা আঁকাবাঁকা হয়, এই সত্যটাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে তৈরি হয়েছে বর্ণিল লাচুং যাওয়ার সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। কখনো জমাট বরফ, কখনো পাথরের স্তূপ, কখনো ঝরনার মাঝ দিয়ে আবার কখনো নদীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা এই রাস্তায় চোখ বন্ধ করলেই চোখের শান্তি নষ্ট। বছরের এই সময়টাতে ২৪ রকমের রডোড্রেনড্রন ফুল একসঙ্গে ফোটে এখানে। সঙ্গে সাদা-হলুদ ম্যাগনোলিয়া, নীলচে আইরিস আর টকটকে পপি ফুলের রঙের ছটায় চোখ ফেরানো দায়।

তবে নজর ফেরাতে হলো। এতক্ষণের সব রংচং, পথ, ফুল, বুনো সৌন্দর্য হটিয়ে বিস্ময়ের সবটুকু দখল করে নিল শুভ্র সৌন্দর্য। আমাদের সামনে সাদা বরফের পাহাড়। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে টুক করে নেমে গেলাম সবাই। স্তব্ধ হয়ে মুহূর্তের পর মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল প্রত্যেকে। চালক রাজুদা একসময় নেমে এসে বললেন, ‘এক ফটো খিঁচেগা?’

এই ছবি তোলার জন্যই তো এত দূরে আসা! পরের আধা ঘণ্টায় লাচুংয়ে সবগুলো বরফের পাহাড় আমরা ক্যামেরায় বন্দী করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। রাজুদা তাগাদা দিলেন, ১১টার আগেই জিরো পয়েন্ট যেতে হবে, নইলে অনুমতি মিলবে না। জিরো পয়েন্টে কী আছে জিজ্ঞেস করতেই রাজুদা চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘উধার মজা আয়েগা!’ আমরা মজাকে দেখার জন্য এখানের মজা অর্ধেক রেখেই রওনা দিলাম।

এতক্ষণ যা দেখেছি তার সবকিছু ম্লান হয়ে গেল জিরো পয়েন্টে এসে। চারপাশে যত দূর চোখ যায় ধবধবে তুষার ঢাকা মাঠ, পাহাড়ের গা বেয়ে বরফ জমে তৈরি হয়েছে বরফের উপত্যকা। হোটেল থেকে ৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে বরফে হাঁটার জন্য গাম বুট নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলো কোথায় কাজে লাগাব এতক্ষণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, এবার মোক্ষম সুযোগ এল। ওদিকে লাল টকটকে জ্যাকেট পরে আমার স্ত্রী নওরিন বরফের মধ্যে দৌড় দিল। তার দেখাদেখি আরও অনেকে।

বরফ ছুড়ে খেলতে খেলতেই আমাদের টনক নড়ল ঘড়ির কাঁটা দেখে। বেলা ২টা। সূর্য একটু হেলে যেতেই কনকনে ঠান্ডা জেঁকে বসেছে। মুহূর্তেই হাত–পা অবশ হয়ে যাওয়ার জো। মেঘ এসে আড়াল করে দিল সবাইকে, কেউ কাউকে দেখছি না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল দুপুরের পর বরফের এলাকাটা সরাসরি ডেথ জোনে রূপ নেয়, তাপমাত্রা প্রতি সেকেন্ডে হিড়হিড় করে কমতে থাকে। সবাইকে এক করে কোনোমতে বরফের ওপর দিয়েই পড়িমরি করে দৌড় শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতেই দেখলাম, রাজুদা বরফের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে ছুটে এসেছেন। ধুপধাপ ভেতরে ঢুকেই জানালা–দরজা বন্ধ করে ঠকঠক করে কাঁপা শুরু করলাম। চোখের সামনে প্রকৃতির সবচেয়ে রহস্যময় সৃষ্টি মেঘে মেঘে ঘোলা হয়ে গেল।

মেঘ ফুঁড়ে আমরা যখন আবার লাচুংয়ের দিকে ফিরছি, মাঝপথে পড়ল ইয়ামথ্যাং উপত্যকা। একে বলা হয় ‘ফুলের উপত্যকা’। লাচুং নদীর পাড় ঘেঁষে শুয়ে থাকা এই উপত্যকায় ফুটেছে রাজ্যের ফুল, দূর থেকে দেখে মনে হয় নীল কার্পেট বিছানো। কথিত আছে, এই উপত্যকায় ফুল ফোটা শুরু করলে নদীর পানিও ধীরে বয়। এক পাশে পাহাড় আর এক পাশে নদী দিয়ে ফুলের উপত্যকায় কাটিয়ে দিলাম জীবনের আনন্দময় কয়েক ঘণ্টা।

বরফযাত্রার এই পথ এখানেই শেষ হয়নি। এরপর আমরা গিয়েছিলাম সমগো হ্রদে। সে আরেক বিস্ময়, সে গল্প না হয় আরেক দিন হবে।

কীভাবে যাবেন?
সিকিম যেতে হলে ভারতের শিলিগুড়ি হয়ে রাংপো সীমান্তে অনুমতি নিতে হয়, নর্থ সিকিম এবং ইস্ট সিকিমে অনুমতি ছাড়া বেড়ানো যাবে না। এ জন্য দরকার এক কপি ছবি, ভিসা এবং পাসপোর্টের ফটোকপি। এখানে ট্যুর অপারেটর ছাড়া অনুমতি দেওয়া হয় না। কাজেই গ্যাংটক পৌঁছে বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানি যাচাই করে ভালো একটা প্যাকেজ নিয়ে নিন। তারাই আপনাকে বলে দেবে ঘোরার জায়গা। আটজনের দল হলে সব মিলিয়ে পাঁচ দিনের সিকিম ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশি টাকায় জনপ্রতি প্রায় ১২ থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হবে।