বান্দরবানের সঙ্গে বন্ধুত্ব

ভুটান আমার খুব প্রিয়। মনে হয় বারবার যাই। ভারতের কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়ে বুঝলাম কেন একে ভূস্বর্গ বলা হয়। তবে দেশের ভেতর যতবার আমি বান্দরবান বেড়াতে গেছি ততবার আমার আফসোস হয়েছে। আহা রে এত সুন্দর দেশটা আমার, যদি পৃথিবীর সবাইকে এনে দেখাতে পারতাম!

একবার সাইরু রিসোর্টের বারান্দায় বসে সূর্য ডোবা দেখছিলাম। মনে হলো যেন কোনো শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্মের স্লাইড শো দেখছি। পুরো আকাশজুড়ে পাঁজা পাঁজা মেঘ। দূরে আরও দূরে সবুজ পাহাড়। নীল, কমলা, লাল, ছাই রঙের খেলা যেন। মনে হচ্ছে শিল্পী তাঁর জাদুর তুলি দিয়ে এক এক টানে যেন এক এক রং দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছেন প্রকৃতি। হঠাৎ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে একটা চান্দের গাড়ি (বান্দরবানে পর্যটকদের জন্য ভাড়া করা খোলা ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি) ভর্তি তরুণ পর্যটক। গলা ছেড়ে গাইছে, ‘ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো...’। প্রতিধ্বনি হতে থাকে সেই তরুণদের কোরাস। যেন যেতে যেতে সেই সুর মেঘে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে। খুশিতে তালি দিয়ে ওঠে স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার চারটি শিশু।

আরেকবার নীলগিরিতে বেড়াতে গিয়ে মনে হলো, যেন মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। এতই উঁচুতে দাঁড়িয়ে, যেন দুটো ডানা থাকলেই উড়ে যেতাম। তাকিয়ে দেখি ওই যে নিচে সুতোর মতো বয়ে চলেছে সাঙ্গু নদ।

আর মিলনছড়ির হিল সাইড রিসোর্টের তক্ষকগুলোও যেন পর্যটকবান্ধব। খাবার ঘরের পেছনের খোলা বারান্দায় বসে আপনি যখন একমনে তাকিয়ে নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতি উপভোগ করবেন, তখন আপনার ধ্যান ভাঙবে কেবল এই তক্ষকের ডাক।

মনে আছে দুদিনের জন্য একবার গেলাম বান্দরবান। এই রিসোর্টের অতিথি দুজন বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে আলাপ হলো। জিজ্ঞেস করলেন কত দিন থাকবেন? দুদিন শুনে চোখ কপালে। হেসে বললেন, ‘এত চমৎকার প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই তো সাত দিন লাগে।’

সবুজ পাহাড়ের নীলাচল। ছবি: পল্লব মোহাইমেন
সবুজ পাহাড়ের নীলাচল। ছবি: পল্লব মোহাইমেন

ঠিক তাই, তাঁদের দেখতাম কোনো তাড়াহুড়ো নেই। খুব ভোরে উঠে এক দফা হেঁটে এসে আয়েশ করে নাশতা খেতেন, তারপর কফির মগ আর বই নিয়ে বারান্দায়। মাঝেমধ্যে চোখ বইয়ের পাতায়, তবে বেশির ভাগ সময় চোখ দুটো আটকে থাকত সামনের দিগন্তে। বিকেলে দেখতাম বিশাল লেন্সের ক্যামেরা নিয়ে চিম্বুক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। দেখা হলে প্রশান্তির হাসি। বুঝতে অসুবিধা হয়নি বান্দরবানের সঙ্গে ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে!

যাঁরা ঘুরতে ভালোবাসেন তাঁদের ছুটির অভাব হয় না। জীবন নকশাই তাঁরা সেভাবে করেন। জীবনের অগ্রাধিকার সেভাবেই সাজান। আমরা সবাই হয়তো সেই দলে পড়ি না, কিন্তু ছুটি পেলে আমরা অনেকেই এখন ঘুরতে যাই। দেশের ভেতর এখন বেড়ানোর অনেক জায়গা। থাকা–খাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত। তাই তো লম্বা ছুটিতে আগেভাগে পরিকল্পনা না করলে জায়গা পাওয়া মুশকিল।

আমার ছোট ভাইদের বন্ধুরা মিলে একটা দল করেছিল প্রাকৃতজন (এই নামে একটা বইয়ের দোকানও করেছিল)। একসঙ্গে ঘুরত। সেই ঘোরায় অত পরিকল্পনা করে, রিসোর্ট বুকিং দিয়ে থাকার ব্যাপার ছিল না। ব্যাকপ্যাক নিয়ে হঠাৎ রওনা। যেখানে রাত সেখানে কাত। মাঝরাতে মাঝির বাড়ি গিয়ে শাক-ভাত খেয়ে আনন্দে ঘুম, আবার হাঁটতে হাঁটতে অজানা জায়গায় গিয়ে অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য দেখে থেকে যাওয়া। এখনো একদল খ্যাপাটে তরুণ এই কাজ করে। এই দলে মনে তরুণ অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষও জুটে যায় কখনো–সখনো। এমন অনেক দল বান্দরবান অঞ্চলে খুঁজে বের করেছে অদ্ভুত সুন্দর ঝরনা। মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে হয় সেখানে। ছবি দেখে আপনার খটকা লাগবে, ‘এটা বাংলাদেশ তো’।

হ্যাঁ, এটাই বাংলাদেশ; এটাই বান্দরবান। আহা যদি পৃথিবীর সব পর্যটককে আকর্ষণ করার ব্যবস্থা করতে পারতাম, তবে ঠিক তারাও প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে থেকে যেত বেশ কয়েকটা দিন। ফিরে গিয়ে তাদের বন্ধুদের বলত, এবার ছুটিতে বাংলাদেশে যাও। চট্টগ্রামে নেমে গাড়ি ভাড়া করে সোজা বান্দরবান। আর হ্যাঁ, দুপুরের খাবারে ব্যাম্বু চিকেন দিতে ভুলো না যেন!