থাইরয়েড সমস্যা ও নারীর জীবন

থাইরয়েডের সমস্যায় বিষণ্নতা দেখা যেতে পারে, সে সময় তার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে হবে। ছবি: অধুনা
থাইরয়েডের সমস্যায় বিষণ্নতা দেখা যেতে পারে, সে সময় তার প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে হবে। ছবি: অধুনা

আমাদের চারপাশে প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন কোনো না কোনোভাবে থাইরয়েডের সমস্যায় আক্রান্ত। নারীর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও সময়ে থাইরয়েড হরমোনের প্রভাব ব্যাপক। এসব সময়ে এই হরমোনজনিত সমস্যা দেখা দিলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে নারীর জীবনের ওপর। আজকাল বলা হচ্ছে থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা নারীদের রুটিন পরীক্ষার আওতায় আনা হোক। বিশেষ করে জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে।

নারীর রজঃজীবন

কৈশোরপ্রাপ্তি ও রজঃস্বলা হওয়া থেকে মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি পর্যন্ত যেকোনো সময়ই থাইরয়েড হরমোনের নানা ভারসাম্যহীনতা নারীর এই রজঃজীবনকে বিপর্যস্ত করতে পারে। অনিয়মিত মাসিক, মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, কখনো মাসিক মাসের পর মাস বন্ধ থাকা হতে পারে থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণ। কিশোরীর মাসিক শুরু হতে অনেক দেরি হওয়া বা খুব অল্প বয়সে সময়ের আগেই শুরু হয়ে যাওয়া, আবার মধ্যবয়সী নারীর সময়ের আগেই মেনোপজ হয়ে যাওয়া বা বেশি বয়স পর্যন্ত অতিরিক্ত মাসিক হতে থাকা—যেকোনো রকমের গোলমালই হতে দেখা যায় থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে। তাই রজঃজীবনের যেকোনো পর্যায়ে যেকোনো রকমের অনিয়ম হলে থাইরয়েড পরীক্ষা করা জরুরি।

নারীর সন্তানধারণ

থাইরয়েড হরমোনের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব নারীর জীবনে ফার্টিলিটি বা সন্তান ধারণ বিষয়ে। বন্ধ্যাত্ব, বারবার গর্ভপাত, গর্ভে সন্তানের মৃত্যু, গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে সমস্যা, সময়ের আগেই সন্তান প্রসব, গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, প্রি একলাম্পসিয়া, একলাম্পসিয়া ইত্যাদি নানা জটিলতা নারীর জীবনকে জটিল করে তোলে এই থাইরয়েড সমস্যা।

হাইপো ও হাইপার থাইরয়েড দুই সমস্যার কারণেই সন্তানধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, নারীর রিপ্রোডাকটিভ বা প্রজননসত্তা জীবনে এত ব্যাপক প্রভাব ফেলে বলে প্রত্যেক নারীর উচিত সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে একবার থাইরয়েড পরীক্ষা করে নেওয়া। সন্তান ধারণে সমস্যা বা বারবার গর্ভপাত হলে তো তা অবশ্যকরণীয়।

স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সামান্য একটু বেশি বা বর্ডারলাইনে (সাবক্লিনিক্যাল) থাকলেও তাঁকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। থাইরয়েডের সমস্যা থেকে থাকলে গর্ভকালীন প্রতি ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পরপর পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা বারবার ঠিক করে নিতে হবে। শুধু রোগ নয়, থাইরয়েডের নানা চিকিৎসাও (যেমন-অ্যান্টিথাইরয়েড ওষুধ, রেডিওআয়োডিন থেরাপি) গর্ভস্থ শিশু, এমনকি কোলের শিশু বা স্তন্যপানকারী শিশুর ক্ষতি করতে পারে। তাই থাইরয়েডজনিত যেকোনো সমস্যা বা চিকিৎসার সময় সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।

নারীর সন্তান পালন

সন্তান ধারণ ও প্রসবের সময় থাইরয়েডের সমস্যা যেমন পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে, তেমনি সন্তান হওয়ার পরও দেখা দিতে পারে নানা নতুন সমস্যা। পোস্ট পারটাম থাইরয়েডাইটিস সন্তান জন্মের পরবর্তী ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় দেখা দিতে পারে। গর্ভকালীন বাড়তে থাকা থাইরক্সিনের মাত্রা আবারও ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনার প্রয়োজন হয় সন্তান জন্মের পরবর্তী সময়ে। ছোট্ট শিশুর সংসর্গ থাকাকালীন রেডিওআয়োডিন অ্যাবলেশন জাতীয় থেরাপি একেবারেই নিষেধ। মায়ের থাইরয়েড সমস্যা থাকলে ভূমিষ্ঠ শিশুরও থাইরয়েড পরীক্ষা করা দরকার পড়ে। আপাতদৃষ্টে সুস্থ সন্তান জন্ম দিলেও গর্ভকালীন মায়ের সামান্য থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা পরবর্তী সময়ে সন্তানের নানা বিকাশজনিত ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে। বাচ্চার কথা বলতে বা দাঁড়াতে দেরি হওয়া, কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট, মেধা ও বৃদ্ধির সঠিক বিকাশ না হওয়া, স্কুলে ফলাফল খারাপ হওয়া বা মনোদৈহিক বৃদ্ধিতে পিছিয়ে পড়ার মতো বিষয়গুলো ধরা পড়তে পারে অনেক দেরিতে।

নারীর শারীরিক–মানসিক সুস্থতা

অকারণ খিটখিটে মেজাজ, বিষণ্নতা, আবেগপ্রবণ আচরণ—জীবনে কোনো না কোনো সময় এই ব্যাপারগুলো নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে জটিল করে তোলে। অনেকেই জানে না যে এর পেছনে থাইরয়েড হরমোনের হাত থাকতে পারে। মুটিয়ে যাওয়া, ত্বক খসখসে বা শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চুল পড়া, হাত–পা ফাটার মতো বিরক্তিকর সমস্যা থেকে ধরা পড়তে পারে থাইরয়েডের সমস্যা। কখনো স্রেফ ক্লান্তি, ভালো না লাগা, অবসাদ, ঘুম ঘুম ভাব, স্ট্যামিনা কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলোকে পাত্তা না দিলেও এই সামান্য জিনিসই হতে পারে থাইরয়েডের সমস্যার লক্ষণ। রক্তশূন্যতা, রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, হৃৎস্পন্দনের বাড়া–কমা, এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়াও হতে পারে এর সঙ্গে জড়িত। নারীর যৌনজীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে এই থাইরয়েড হরমোন।

শেষ কথা

নারীর শারীরিক, মানসিক, প্রজনন ও যৌনজীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ে নানা বিচিত্র উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয় থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা। নারীর জীবনে এই গ্রন্থির প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। খুব সামান্য বা ক্ষুদ্র, প্রায় অনুল্লেখ্য উপসর্গকেও তাই আমলে আনা উচিত। দিন দিন বাড়ছে নারীদের থাইরয়েড হরমোনজনিত রোগ ও জটিলতা।

প্রতিবছর ২৫ মে তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে পালিত হয় বিশ্ব থাইরয়েড দিবস। প্রত্যেক নারীর উচিত নিজের থাইরয়েডকে বোঝা, কখন কী উপসর্গ হলে থাইরয়েড পরীক্ষা করতে হবে তা জানা, এবং সন্তান ধারণের পরিকল্পনা করার সময় থাইরয়েডকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।

লেখক: চিকিৎসক ও হরমোন বিশেষজ্ঞ