শরীর ভালো রাখাই তারুণ্য

শম্পা রেজা ৬১ বছর বয়সেও ধরে রেখেছেন তারুণ্য
শম্পা রেজা ৬১ বছর বয়সেও ধরে রেখেছেন তারুণ্য
>

প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের বয়স বাড়ে। সেই বেশি বয়সেরও আলাদা একটা সৌন্দর্য রয়েছে। বেশি বয়সেও তারুণ্য ধরে রাখার মূল ব্যাপার হলো শরীর সুস্থ রাখা আর মনকে আনন্দে রাখা। লিখেছেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা।

আমি আসলে চেষ্টা–চরিত করে তারুণ্য ধরে রাখার বিষয়টার মধ্যে নেই। যেমন জন্মেছিলাম, আজও তেমন একটি স্বাধীন সত্তা বা স্বাধীন আত্মা নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করি। আমার আত্মা ঘুরতে পছন্দ করে এই পৃথিবীতে। আর তা এই পৃথিবীকে দারুণ জায়গা হিসেবে নেয়। অথবা সেই আত্মার কোনো ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি নেই কারণ আমি এখনো অবাক হই। অনেক অনুভূতি পাই পৃথিবীর কাছ থেকে। সেটা নিয়ে আমার পথচলা।

৬১ বছর বয়সেও আমার মনে উৎসাহ কমেনি। বিশ্বাস করি পৃথিবীতে একটা প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের বয়স বা বছরগুলো যোগ হয়। এই নিয়মের বিরুদ্ধে আমার কোনো যুদ্ধ নেই। এই নিয়মটা আমি খুবই মজা ও আনন্দ নিয়ে উপলব্ধি করি। খুবই মজা নিয়ে গ্রহণ করি। তাই আমার চুল সাদা হলেই কী, আর আমার শরীরের এখানে–ওখানে বলিরেখা পড়লেই বা কী। এগুলো নিয়ে আমার কোনো বিকার নেই, কোনো কষ্ট নেই। কোনো রকম চেষ্টাও নেই এগুলো ঠেকানোর।

এই যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের ওপর, আমাদের নিয়ে ছবি আঁকছেন, এতগুলো বছর ধরে। এ ছবিটি দেখার খুব আগ্রহ আমার। তবে আমি খুব একটা সময় পাই না আয়নার সামনে দাঁড়ানোর, আমার ছবিটা দেখার। প্রকৃতি যে ছবি আঁকে আমাদের ওপরে সেই ছবি দেখতে আমার খুবই মজা লাগে। এটার সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই।

অতএব তারুণ্য বলতে যদি আমরা বুঝি পোশাকের তারুণ্য কিংবা আলাদাভাবে নিজেকে ব্যক্ত করা, সেটা কিন্তু তরুণ্য নয়। জীবনের তারুণ্য হলো আসলে মনের তরুণ্য। সেই মনকে সতেজ রাখতে পারে কেবল পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা।

আমি খুবই নিয়ম মেনে চলি। আমি ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত। সংগীত সাধনার জন্য ভোর বেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। সংগীতের যে সাধনার জায়গা, ওটা যুক্ত করে দেয় বিশ্বের সঙ্গে। আমাকে আশ্চর্যও করে এটা কোথা থেকে আসছে। কেমন করে আসে এগুলো? আমরা মন এসব খুঁজতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সংগীত আমাকে একটা নিয়মের জীবন দিয়ে দিয়েছে। সেটা জন্মগতভাবেই পেয়েছি আমি।

এমনিতেই আমাদের সময়ের মানুষেরা নিয়ম মেনে চলাফেরা করত। সে জন্য সত্যিকার অর্থে শরীর ভালো থাকত। পাশাপাশি আমাদের সময় খাদ্য গ্রহণের বিষয়টাও ছিল খুবই স্বাস্থ্যকর। আশপাশে প্রচুর ফল ছিল। গাছপাকা ফল। গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার মজা পেতাম আমরা। সে ফলগুলোর মধ্যে ফরমালিন ছিল না, কেনো কীটনাশক, কৃত্রিম সার ছিল না। এসব খাবারও আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। কারণ আমরা কী খাচ্ছি, সেটাও তো খুব জরুরি।

আজকের যে জীবনযাপনের জায়গা, যেখানে ফেসবুক আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। এর আগ্রাসনও আছে। আমাদের আজকের সমাজে ভিজ্যুয়াল জায়গাটার বিষম আগ্রাসন। আমরা খুব সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় হয়েছি। প্রকৃতি দিয়েছে, আমরা গ্রহণ করেছি। প্রকৃতিকে ভালোবেসে তাকেও আমরা দেখে রেখেছি। ওই সময় আমরা বেড়ে উঠেছি। এই জায়গা থেকে আজকের সমাজে তো বিরাট একটা অমিল বা গরমিল আছেই। সব মিলিয়ে তখন সমাজ ছিল আমাদের পক্ষে। আমার সংগীত, আমার পরিবার আমাকে নিয়ম মেনে চলতে শিখিয়েছে। আর আমিও নিয়ম মেনে চলতে খুবই ভালোবাসি এবং পছন্দ করি। নিয়ম মেনে চলার মধ্যেই একধরনের সুস্থতা। আমি আজ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের কাছে যাইনি, কোনো ওষুধ খাইনি। আমার রক্তচাপের কোনো সমস্যা নেই, সুগার নেই। এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ। এই সুস্থ থাকার জন্য আমি যে খুব চেষ্টা করি, তা–ও না। আমার মন যেটা বলে আমি সেটাই খাই, সেটাই করি।

সংগীত সাধনা যোগাসন হিসেবে কাজ করে। সংগীত করার সময় আমি যোগাসনে বসি। আমরা ছোটবেলা থেকে যোগাসন করেছি। পরে যোগাসন আমার সংগীতেও কাজে লেগেছে। আমি যখন শান্তিনিকেতনে ছিলাম, তখন আমি যোগাসনে আগ্রহী ছিলাম। সুস্থ থাকার বিষয় এটা টনিক হিসেবে কাজ করেছে।

আমার জীবনে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা করা যাবে, ওটা করা যাবে না—এভাবে আমি কোনো দিনই চলিনি। তবে আমি ছোটবেলা থেকে পোষা প্রাণীদের সঙ্গে বড় হয়েছি। আমার সঙ্গে সব সময় একটা সারমেয় থাকত। তাদের সঙ্গে থেকে একটা জিনিস শিখেছি। আমি খিদে না পেলে খাই না। এটা প্রাণীদের কাছ থেকে পাওয়া। আমার যখন খিদে পায়, তখনই খাই। আমার তিন বেলা খেতে হবে এমন নিয়মে চলিনি কোনো সময়েই। তবে খিদে পেলে আমি বেশ খাই।

আসলে তরুণ্য ধরে রাখা নয়, শরীর ভালো রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যাদে অসুস্থ হয়ে না পড়ি। আমি যদি জোর করে আমার ৬১ বছরকে ৩২ বছর বয়সে টেনে আনার চেষ্টা করি, সেটা তো খুব স্বাস্থ্যকর নয়। এটা অনুধাবন করে নিতে হবে। সবকিছু গ্রহণ করতে হবে। বয়স বাড়া তো মজার বিষয়। কারণ যদি তুমি চাও পৃথিবীতে তুমি যত বছর বাঁচবে, তত বছর তো তোমার জ্ঞান অর্জনের বিরাট ক্ষেত্র। সেটাকেই তুমি সাধনা হিসেবে নাও। শুধু নিজের বাহ্যিক রূপে মুগ্ধ হওয়া তো পৃথিবীতে আসার কারণ নয়। বাহ্যিক রূপ তো একটা উপকরণ, যেটা সৃষ্টিকর্তা দিয়ে দেন। এখানে তো কারও হাত নেই।

একসময় চামড়া কুঁচকাবে, বুকটা ধকধক করবে এবং কিডনি অন্যভাবে কাজ করবে। মানুষের জীবনকালের মধ্যে এটা–ওটা–সেটার নড়চড় হয়ে যাবে। তা মেনে নিতে হবে। আসল কথা হলো মৃত্যুকে মেনে নেওয়া। সেটাই সবচেয়ে বড় সত্য। প্রকৃতির বিষয়গুলো মেনে নেওয়াও একটা মজা আছে আমার কাছে। কেউ যদি সার্জারি, ফেস বা বডি শেপিং এবং চামড়ার রং বদল করে, সেটা যদি কারও পছন্দ হয়, তাহলে কেন করবে না। সারা বিশ্বেই একটা হচ্ছে। অনেকেই এর সৎ ব্যবহার করছেন। কেনইবা করবেন না। যাঁরা করেন, এটা তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আমার কসমেটিক সার্জারি প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিলাম। এতে আমি মহা মজা পাই। প্রকৃতির সঙ্গে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দিই আমি।

আগামীর দিনগুলোয় আমি কিচ্ছুই চাই না। যেমন আছে, তেমনই চলুক। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে আমি খুব দামি মনে করি। মানুষের মুহূর্ত তো অনেক কম। মুহূর্তগুলোকে ধরে ধরে আমি সাজাই। নানা ভাবনা দিয়ে, সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে আমি আমার ক্ষণগুলো মূল্যবান করে তুলি।

অনুলিখিত