ঈদে হাতে বানানো সেমাই থাকছে তো?

হাতে কাটা সেমাই দিয়ে একসময় হতো ঈদের দিনের মিষ্টিমুখ। ছবি: খালেদ সরকার, কৃতজ্ঞতা: সিতারা ফিরদৌস
হাতে কাটা সেমাই দিয়ে একসময় হতো ঈদের দিনের মিষ্টিমুখ। ছবি: খালেদ সরকার, কৃতজ্ঞতা: সিতারা ফিরদৌস

ঈদের সকালে পাটভাঙা নতুন কাপড় গায়ে জড়িয়ে খাবার টেবিলে বসে মনের অজান্তেই আপনার চোখ এবং হাত যে খাবারটির দিকে চলে যাবে, সেটি সেমাই; দুধ–চিনি–বাদাম দিয়ে রান্না করা সেমাই। আপনি খাবার শুরুও করতে পারেন সেমাই দিয়ে আবার শেষও করতে পারেন সেটি দিয়েই। যা–ই করুন না কেন, সেমাই আপনাকে খেতে হবে— সে এক চামচই হোক আর এক বাটিই হোক। ঈদের সকালে বাঙালি ঘরের এ প্রথা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কোর্মা–পোলাও–কালিয়া–বিরিয়ানি যা–ই হোক না কেন, সেমাই না হলে ঈদ যেন ঠিক জমে ওঠে না। দুধ, চিনি, বাদাম দিয়ে রান্না করা সেমাই বাংলাদেশের ঈদের খাবারের আইকন। খাবার টেবিলে বাহারি পদের খাবারের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা সেমাইর বাটি বাঙালি বাড়ির ঈদের চিরন্তনী দৃশ্য। মোগলাই বা ইউরোপিয়ান খাবার টেবিলে থাকলেও ঈদের সকালে সবকিছুর আগে সুস্বাদু সেমাই খেতে দেওয়া হবে—এটা বাঙালি প্রথা।

হরেক পদের সেমাই পাবেন বাজারে। সেখানে প্যাকেটজাত শুকনো লম্বা সেমাই যেমন আছে, তেমনি আছে লাচ্চা সেমাই। এই ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেমাই’ বা কারখানায় বানানো সেমাই বেশ লম্বা আকৃতির হয়ে থাকে। কারখানায় বানানো লম্বা আকৃতির সেমাই এখন ঈদের আইকন হলেও, ঈদের দিন কান পাতলেই আপনি শুনতে পাবেন হাতে বানানো সেমাইয়ের গল্প। এই একুশ শতকে হাতে বানানো সেমাইয়ের বহুল প্রচলন না থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চলে এটি বানানো হয় এখনো। যেমন রাজশাহী জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনো হাতে তৈরি সেমাইয়ের প্রচলন রয়েছ। এই অঞ্চলে এখনো নারীরা বাজারের কেনা সেমাইয়ের পাশাপাশি বাড়িতে হাতে সেমাই বানায়। এই অঞ্চলের মানুষ ঈদে যে ‘জামাই সাজন’ পাঠায়, তার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো হাতে বানানো সেমাই।

হাতে কাটা সেমাই। ছবি: খালেদ সরকার
হাতে কাটা সেমাই। ছবি: খালেদ সরকার

হাতে বানানো সেমাইয়ের দুটি ধরন রয়েছে। একটি হাতে ডলে ডলে বানানো সেমাই, অন্যটি হাতে ঘোরানো যন্ত্র দিয়ে বানানো সেমাই। হাতে ডলে বানানো সেমাইয়ের প্রচলন প্রাচীন। চালের আটা ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে মণ্ড বানিয়ে সেই মণ্ড পরিমাণমতো হাতে নিয়ে ডলে ছোট ছোট লম্বা সরু নালি তৈরি করা হয় প্রথমে। তারপর সেখান থেকে পরিমাণমতো কেটে নিয়ে তৈরি করে সেমাই বানানো হয়। সেগুলোকে রোদে শুকিয়ে রেখে ঈদের দিন রান্না করা হয় দুধ দিয়ে। পরবর্তীকালে সেমাই বানানোর যন্ত্র আবিষ্কৃত হলে সেই যন্ত্রে সেমাই বানানোর প্রচলন হয়। যন্ত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ আটার মণ্ড রেখে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেমাই তৈরি করে বাড়ির নারীরা। যদিও এখন এই সেমাই তৈরি প্রক্রিয়াও প্রায় অপ্রচলিত হয়ে গেছে।

আমাদের কাছে ‘সেমাই’ নামে পরিচিত এই খাবারের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধান যেসব অঞ্চলে উৎপন্ন হয়, সেসব অঞ্চলে চাল থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক আগে। ভারত উপমহাদেশে ধান চাষের বয়স সাত–দশ হাজার বছরের পুরোনো। সে কারণে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে চাল দিয়ে বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেমাইও সেই আবিষ্কার ধারার একটি খাবার। পৃথিবীতে ‘ভার্মিচিলি’ গোত্রের যে খাবারটি রয়েছে, যার জনপ্রিয় প্রজাতি হিসেবে আমরা পাস্তা, নুডলস ইত্যাদি খাবারকে চিনি, সেই খাবারের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের একটি ধরন হিসেবে সেমাইয়ের উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এটি সেমাই ও সিমুই হিসেবে পরিচিত। আবার তামিল ও মালয়ালাম ভাষায় এটি সেভাই, কন্নড় ভাষায় সেবিজ, তেলেগু ভাষায় সেভেলু বা সেমিয়া, তামিলে সেমিয়া, হিন্দি, উর্দু ও পাঞ্জাবি ভাষায় এটি সেভিয়াঁ, ওড়িয়া ভাষায় সিমাই, গুজরাঠি ভাষায় সেভ নামে পরিচিত। যেসব ভাষার কথা বলা হলো সেসব দেশে সেমাইয়ের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রন্ধনপ্রণালি। তবে বেশির ভাগ অঞ্চলেই মিষ্টিজাতীয় খাবার হিসেবেই পরিচিত।

রান্না করা হাতে কাটা সেমাই। ছবি: খালেদ সরকার
রান্না করা হাতে কাটা সেমাই। ছবি: খালেদ সরকার

অনেকেই মনে করেন, সেমাই পার্শিয়ান খাবার যেটি মোগলদের হাত ধরে ভারতে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জানা যাচ্ছে, পার্শিয়ান খাবার রেস্তেহ বা তুরস্কের খাবার কেস্মে বা এরিস্টের সঙ্গে সেমাইয়ের আকৃতিগত কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও স্বাদগত কোনো সাদৃশ্য নেই। কেস্মে বা এরিস্ট কিংবা রেস্তেহ এগ নুডলস হিসেবে খাওয়া হয়। আর সেমাই খাওয়া হয় মিষ্টি খাবার হিসেবে।

সে যা–ই হোক না কেন, যে দেশেই বা যে অঞ্চলেই সেমাইয়ের জন্ম হোক না কেন, বাঙালি তার তোয়াক্কা কবে করেছে? সেমাই তৈরির যন্ত্র সেমাইয়ের উৎপাদনকে দ্রুত ও বর্ধিত করেছে। কিন্তু হাতে বানানো সেমাই মানুষকে মমতার, ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। বছরের সুবিধামতো সময়ে হাতে বানিয়ে সেমাই শুষ্ক অবস্থায় সংরক্ষণ করে রাখা হয় মূলত ঈদে খাবার জন্য। ঈদের আগের দিনও হাতে সেমাই বানানোর প্রচলন রয়েছে। বাড়ির নারীরা সবাই মিলে চাঁদ রাতে সেমাই তৈরি করছে, এ দৃশ্য এখনো বিমোহিত করে রাখে অনেককে। সেমাই বিষয়টির সঙ্গে একান্তভাবে জড়িয়ে রয়েছেন নারীরা। সে কারণে মা, নানি, দাদি, খালা, ফুফুর স্মৃতি ভেসে ওঠে ঈদের সকালে দুধ দিয়ে রান্না করা ধোঁয়া ওঠা সেমাই খেতে খেতে।

হাতে বানানো সেমাইয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেমাই অর্থাৎ কারখানায় বানানো সেমাই। এতে করেও হাতে বানানো সেমাই খাওয়ায় ভাটা পড়েনি খুব একটা। কোনো কোনো পরিবারে এখনো বাজারের কেনা সেমাইয়ের পাশাপাশি ঐতিহ্য মেনে ঈদে হাতে বানানো সেমাই খাওয়া হয়, খাওয়ানো হয়।

সৌজন্যে: প্রথম আলো বর্ণিল ঈদ