ঈদে ঘুরে আসুন পার্বত্য খাগড়াছড়ি

মাতাই পুকুরী যাওয়ার পথে এমন পাহাড়ি ছড়ার সন্ধান মিলবে। ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান
মাতাই পুকুরী যাওয়ার পথে এমন পাহাড়ি ছড়ার সন্ধান মিলবে। ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান

পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সর্পিল রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে পার্বত্য খাগড়াছড়ি। পাহাড়, বন, স্বচ্ছ পানির ছড়া, ঝরনা, চা-বাগান, বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক গুহাসহ খাগড়াছড়িতে রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্র। আর ঈদ উপলক্ষে খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্রগুলো সাজানো হয়েছে নানাভাবে। হোটেল-মোটেলগুলোতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে এ সময়ে। রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থাও। তাই এবারেই ঈদে চাইলে বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন খাগড়াছড়িতে।

খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মোহা. আহমার উজ্জামান বলেন, খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ঈদের আগে ও পরে সড়কে এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তিন স্তরের নজরদারি।

খাগড়াছড়িতে যে কদিন থাকবেন বেছে বেছে যেতে পারেন জেলার বিশেষ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। স্বল্প সময়ে এবং সাশ্রয়ী খরচে আপনি এসব জায়গা ঘুরতে পারেন।
আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র ও গুহা
আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙ্গা সড়কে। এটি খাগড়াছড়ির ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট। সূর্যাস্তের পর আলুটিলা থেকে খাগড়াছড়ি দেখার আনন্দই আলাদা। রাতের খাগড়াছড়ি শহর যেন আর এক মনলোভা দৃশ্য। দূর থেকে দেখা যায় ঘন কালো অন্ধকারে হাজার হাজার বাতির মিটি মিটি আলো। এ দৃশ্য বিনোদনপ্রেমী একজন পর্যটককে আনন্দ দেবে। আলুটিলায় পর্যটকদের জন্য বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে।
এই আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রে আছে একটি প্রাকৃতিক গুহা, যা এই কেন্দ্রের মূল আকর্ষণ। এই গুহা ২৮২ ফুট দৈর্ঘ্য। গুহার একপাশ থেকে অন্য পাশে যেতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট। একপাশ থেকে অন্যপাশে পানি প্রবহমান। গুহার ভেতর অনেক অন্ধকার, তাই টর্চ লাইট বা মশাল নিয়ে যেতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রের গেটে ১০ টাকা দিয়ে মশাল পাওয়া যাবে। নিজের সঙ্গে মশাল জ্বালানোর জন্য দেশলাই নিতে ভুলবেন না। প্রবেশ পথের টিকিটের দাম ১০ টাকা। চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে অথবা লোকাল বাস বা সিএনজিচালিত অটোতে করে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রে যেতে পারবেন। লোকাল বাসে ভাড়া লাগবে ১০ থেকে ১৫ টাকা।

রিছাং ঝরনা
আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের পাদদেশে এই ঝরনাটি। স্থানীয় মারমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঝরনাটিকে রিছাং ঝরনা নাম দিয়েছে। এ ঝরনা থেকে কিছু দূরে প্রায় ৩০ হাত উচ্চতার আরও একটি ঝরনার দেখা মিলবে। পাহাড় আর সবুজের বুক চিরে পড়া ঠান্ডা পানি অনবরত দুই ঝরনার বুক দিয়ে ছুটে চলছে।
কীভাবে যাবেন
চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করতে লাগবে ১২০০ টাকা। লোকাল বাসে গেলে ৩০ টাকা।

জেলা পরিষদ পার্ক
শহরের একদম কাছেই জেলা পরিষদ পার্ক। শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে এই পার্ক। পার্কে প্রবেশ করার আগে দেখতে পাবেন একটি সুউচ্চ বুদ্ধমূর্তি। পার্কে রয়েছে একটি ঝুলন্ত সেতু ও একটি লেক। লেকে চাইলে আপনি চড়তে পারবেন নৌকায়।
কীভাবে যাবেন
জেলা শহর থেকে সব সময় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাওয়া যায়। শহরের শাপলা চত্বর থেকে ভাড়া ২০ টাকা।

দেবতা পুকুর
জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মাইসছড়ির নুনছড়িতে ৭৫০ ফুট ওপরে অবস্থিত একটি ভিন্ন প্রকৃতির স্বচ্ছ পানির অপূর্ব প্রাকৃতিক পুকুর। স্থানীয় আদিবাসী ত্রিপুরাদের মতে, পাহাড়ের ওপরের এই পুকুরের পানি কখনো কমে না এবং পানি পরিষ্কারও করতে হয় না। তাই ত্রিপুরারা এর নাম দিয়েছে মাতাই পুখুরি। অর্থাৎ দেবতা পুকুর। বছরের অধিকাংশ সময় পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায় এ পুকুরে।
কীভাবে যাবেন
শহরের শাপলা চত্বর থেকে চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করতে পারেন। ভাড়া পড়বে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। তা ছাড়া বাসস্টেশন থেকে রাঙামাটির গাড়িতে উঠে আপনি মাইসছড়ি নেমে যেতে পারেন, সেখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা। সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট।

পানছড়ি অরণ্য কুটির ও রাবার ড্যাম
খাগড়াছড়ি জেলা থেকে ২৫ কিমি উত্তরে, পানছড়ি সদর উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শান্তিপুর অরণ্য কুটির। এই কুটিরে প্রবেশ মুহূর্তে চোখে পড়বে নয়নাভিরাম ৪৮.৫ ফুট উচ্চতার বৃহৎ বুদ্ধমূর্তি, যা মুহূর্তেই অভিভূত করবে যে কাউকে। মূল মূর্তিটি ৪২ ফুট এবং বেদিটি ৬.৫ ফুট উঁচু। সব নিয়ে মূর্তিটি ৪৮.৫ ফুট উঁচু। এই বুদ্ধমূর্তি দেখার জন্য প্রতিদিন এইখানে ভিড় করে শত শত পর্যটক। পানছড়ি অরণ্য কুটির থেকে ৩ কিমি আগে রয়েছে একটি রাবার ড্যাম। এটি অরণ্য কুটির যাওয়ার পথেই পড়বে। ২০০৪ সালে প্রায় ১.৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৬৫ একর জায়গা নিয়ে শান্তিপুর অরণ্য কুটির অবস্থিত।
খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি অরণ্য কুটির যাওয়া যায়। আসা-যাওয়া ভাড়া ৮০০ টাকা পড়বে। পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের শান্তিপুর এলাকা থেকে ৩ কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ের ওপর অরণ্য কুটির। যাওয়ার পথে চেঙ্গি নদীর ওপর নির্মিত রাবার ড্যাম দেখা যাবে।

মায়াবিনী লেকে নৌকা চালাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান
মায়াবিনী লেকে নৌকা চালাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: জয়ন্তী দেওয়ান


মায়াবিনী লেক
পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে ভাইবোনছড়া কংচারীপাড়া এলাকায় কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই পর্যটনকেন্দ্র। প্রায় ১৫ একর জায়গাজুড়ে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাঁশের সাঁকো, আমবাগান। চাইলে আপনি বাগান থেকে কিনতে পারবেন বাজারের দামে আম। বড়শি দিয়ে লেক থেকে ধরতে পারবেন মাছ। তবে ধরা মাছগুলো বাজার ধরে কিনতে হবে আপনাকে। খাগড়াছড়ি জেলায় একমাত্র মায়াবিনী লেকে আছে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থা। তা ছাড়া লেকে ঘুরতে পারবেন পঙ্খীরাজ নৌকায়।
যেভাবে যাবেন
খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি অরণ্য কুটির যাওয়া যায়। আসা-যাওয়া ভাড়া ৬০০ টাকা পড়বে। এ ছাড়া লোকাল জিপে যেতে হলে ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা।

তৈদুছড়া ঝরনা
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও দীঘিনালা উপজেলার সীমান্তস্থল দুর্গম সীমানাপাড়া গ্রামে অবস্থিত তৈদুছড়া ঝরনা। আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে এ ঝরনায়। ঝরনায় পৌঁছানোর আগে আপনি দেখতে পাবেন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা। শেষ পর্যায় দেখবেন বিশাল বিশাল হাতির মাথা আকৃতির পাথরের সারি । তারপর বিশাল সেই তৈদুছড়া ঝরনা। ঝরনার সেই পানির প্রবাহ দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন আরও একটি সুউচ্চ ঝরনা। ভাড়া করা চাঁদের গাড়ি এই রাস্তার জন্য উপযুক্ত। ভাড়া পড়বে ২০০০ টাকা। সময় লাগবে প্রায় ৩৫ মিনিটি। না হয় দীঘিনালা বাসে উঠে নয়মাইল নেমে হেঁটে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে নয়মাইল থেকে হেঁটে তৈদুছড়া পৌঁছাতে লাগবে প্রায় দুই ঘণ্টা। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লোকজনের জন্য এটি উপভোগ্য হবে।

খাগড়াছড়ি কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাসে করে খাগড়াছড়ি যেতে হবে। নন-এসি বাস ভাড়া ৫৫০ টাকা এবং এসি বাস ভাড়া ১০০০-১২০০ টাকা। সেন্ট মার্টিন পরিবহন, নন-এসি বাস শ্যামলী-শান্তি পরিবহন, ঈগল, ইকোনো, সৌদিয়া, এস আলম বাসে খাগড়াছড়ি যেতে পারেন। এসব বাস ঢাকা থেকে বাস ছাড়ে সাভার, গাবতলী, কলাবাগান, কল্যাণপুর, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর সকালে ও রাতে (১১.০০ টায়) এবং খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়ে সকালে ও রাতে (৯.০০ টায়) ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি যেতে সময় লাগবে রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা এবং দিনে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।

চট্টগ্রাম থেকে যেতে হলে আপনাকে যেতে হবে অক্সিজেন। শান্তি, বিআরটিসি ও লোকাল বাস যায় থেকে খাগড়াছড়িতে।
ভাড়া- শান্তি-১৯০ টাকা, লোকাল ১৭০-১৮০, বিআরটিসি-২০০। খাগড়াছড়ি যেতে সময় লাগবে ৩-৪ ঘণ্টা।

খাগড়াছড়িতে থাকার ব্যবস্থা
পর্যটন মোটেল: হোটেল গাইরি, হোটেল ইকোছড়ি, শৈল সুবর্ণ।