ভ্রমণই উপভোগ করুন

বেড়াতে গিয়ে অন্য কিছু নয়, সেই জায়গাটাই উপভোগ করা ভালো। ভারতের লাদাখের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক
বেড়াতে গিয়ে অন্য কিছু নয়, সেই জায়গাটাই উপভোগ করা ভালো। ভারতের লাদাখের একটি দৃশ্য। ছবি: লেখক

ঈদ যদিও শেষ, তবু এখনো অনেকেই দেশে-বিদেশে ঈদের ছুটিতে আছেন। হাতের মুঠোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চলে আসার কারণে এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছুটি এবং সরাসরি প্রচারিত রম্য প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে আর পার্থক্য করা যাচ্ছে না। আমার নিজেরও এ রকম হয়েছে। দেখা গেল দেশের বাইরে গেছি। খেতে বের হয়েছি। খাবার আসার পর সেটার ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করতে করতে খিদেই চলে গেছে। কিংবা কোনো একটা সুন্দর জায়গায় গেলাম। কই উপভোগ করব, তা না করে পৃথিবীকে জানাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে আমি একটা সুন্দর জায়গায় এসেছি। সূর্যাস্তের ছবি তুলে শেয়ার করতে করতে সূর্যই ডুবে গেছে। সূর্যাস্তের জাদু আর উপভোগ করা হয়নি।

ভ্রমণের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় কাটানোর দুটো খারাপ দিক আছে। একটা হলো ভ্রমণের আনন্দ পুরোপুরিভাবে উপভোগ করা যায় না। দ্বিতীয়টা হলো আপনি যে মানুষের সঙ্গে ভ্রমণ করছেন, তাকে যথাযথ সময় বা তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয় না। প্রথম সমস্যাটা শুধু ভ্রমণ নয়, জীবনের সব ব্যাপারেই প্রযোজ্য। মনে করেন, সকালে গোসল করতে ঢুকেছেন। এখন যদি সাবান দেওয়া থেকে গা মোছা পর্যন্ত সবকিছু তাৎক্ষণিক কাউকে বর্ণনা করতে হয়, তাহলে গোসল করার বিষয়টা আর কতই-বা আরামের হবে? সমস্যা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের প্রতিটা বিষয় সবার সঙ্গে শেয়ার করার একধরনের চাপ সবার মধ্যে কমবেশি কাজ করে। দেশে-বিদেশে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা তাঁদের নিজের জীবনের প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করে। মানুষ সেটা দেখেও এবং যারা লাইভ করে, তারা সেটা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালো পরিমাণে অর্থ উপার্জনও করে। মহা বিপদ। এমতাবস্থায় ভ্রমণের মতো বিশেষ অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার স্পৃহা কাটানো সহজ বিষয় নয়। তবে যদি কাটাতে পারা যায়, তাহলে ভালো। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি মধুর হয়ে ওঠে।

কয়েক বছর আগে আমি এই শেয়ারিংয়ের সমস্যাটা প্রথম উপলব্ধি করি। তবে দেখে নয়, ঠেকে। সেবার আমি একাই ভারতের লাদাখে গিয়েছিলাম সাইক্লিং করতে আর ছবি তুলতে। সেই সময় লাদাখ এমনই এক দূরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন ছিল যে সেখানে বেশির ভাগ জায়গায় ইন্টারনেট পাওয়া যেত না। প্রথম এক-দুই দিন খুব কষ্ট হলো। কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদকদ্রব্য না দিলে যে রকম হয়, সে রকম হতে লাগল। যা-ই দেখি, মনে হয় এই বন্ধু সেই বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করতে হবে কিন্তু শেয়ার করতে পারছি না। দু-এক দিন পর দেখলাম যে সবকিছু শেয়ার করার অস্থিরতা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। ভূস্বর্গে এসে আমার মন আস্তে আস্তে ফোন থেকে স্বর্গের দিকে যাচ্ছে। সুন্দর কিছু দেখলে সেটার ওপর মনোনিবেশ করতে পারছি। উপভোগ করতে পারছি। ফোন গুঁতোগুঁতি করছি না। সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার না করতে পারার কারণে আরেকটা জিনিস হলো। আমি আমার কাছের কিছু মানুষকে চিঠি লেখা শুরু করলাম। সারা দিন কী দেখলাম, কী কী অভিজ্ঞতা হলো, সেগুলো দিনের শেষে বিস্তারিতভাবে লিখে ফেললাম। অভিজ্ঞতার কথা কাছের মানুষকে জানানোও হলো আর অভিজ্ঞতার একটা দলিলও থেকে গেল। লেখার সময় অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে আরেকটু সময় কাটালাম। আর সে কারণে সুমধুর সময়টা আরেকটু দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেল আমার মস্তিষ্কে, স্মৃতিতে। লাদাখের সেই ছুটির পর থেকে আমি আসলেই চেষ্টা করি ভ্রমণের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যাতে একটু হলেও বিচ্ছিন্ন থাকা যায়। সব সময় যে সেটা খুব কার্যকর হয়, তা নয়। যতক্ষণ জেগে থাকি ফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সঙ্গে থাকে। এ রকম অবস্থায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন কাজ। তবে আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে যে সফরের সময় ফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে যত দূরে থাকা যায়, সফর তত উপভোগ্য হয়।

ভ্রমণের সময় লেখার বিষয়টাতে ফিরে আসি। ভ্রমণের সময় যে চিঠিই লিখতে হবে, সে রকম নয়। তবে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো যদি একটু সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শেয়ার করা যায়, সেটাও চিঠি বা প্রবন্ধের মতোই কাজ করে। কিছুদিন আগে দেখলাম আমার এক বন্ধু তার ভ্রমণের সময় কী কী করল, কোথায় কোথায় গেল, সেগুলোর প্রতিদিনের বিস্তারিত বর্ণনা ছবিসহ দিনের শেষে ফেসবুকে লিখছে। এত সুন্দর করে লিখছে যে পড়ে মনে হলো আমি তার সঙ্গে ভ্রমণে আছি। দূরদেশের অসাধারণ সব জিনিস তার সঙ্গে উপভোগ করছি। তার ভ্রমণের আনন্দ আমার আনন্দ হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত যে কয়েক বছর পর যখন তার নিজের এই ভ্রমণের স্মৃতি ক্ষীণ হয়ে আসবে, সে নিজেও এই বর্ণনাগুলো পড়ে আনন্দ পাবে। এ রকম বর্ণনা তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার করলে অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি তুলে ধরা কঠিন। নিজের আনন্দ প্রকাশ করা কঠিন। নিজের আনন্দ শেয়ার করে অন্যকে আনন্দ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আপনি যদি একটু পরপর শেয়ার করতে থাকেন, অন্যরা আপনার আনন্দে খুশি না হয়ে বিরক্ত হচ্ছে। আপনার আনন্দের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হচ্ছে। তার চেয়ে একটু সময় নিয়ে রয়েসয়ে শেয়ার করলে নিজের এবং অন্যের আনন্দ দুটোই বাড়ে।

আমরা বেশির ভাগ মানুষই জীবনের খুব কম সময় দেশ-বিদেশ ভ্রমণে কাটাতে পারি। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য দুর্লভ আনন্দের। এই অভিজ্ঞতা ফোন আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটিয়ে হালকা করা হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ফোন তো সারাক্ষণই সঙ্গে থাকবে। ভ্রমণ তো মাত্র কয়েক দিনের। আপনাদের সবার ভ্রমণ আনন্দময় হোক।

লেখক: অভিনেতা