সেই মিরাজই আমার মুখ উজ্জ্বল করল

ভাবতে পারিনি ছেলেটা এত দূর যাবে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য কত বকাঝকা করেছি, মারধর করেছি। এ জন্য এখন অনুতাপ হয়। ছেলের এমন কৃতিত্বে বাবা হিসেবে কে না গর্বিত হয়। তবে এই গর্ব আমার একার নয়, গোটা বাংলাদেশের। ছেলেকে আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করেছি। সব সময় দোয়া করি, আমাদের ছেলেরা যেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। ১২ জুন রাতেও ভিডিও কলে কথা হয়েছে। তখনও বলেছি, ‘বাবা, আমরা তোমার কাছে কিছু চাই না। তোমরা দেশের জন্য লড়াই করো, দেশ-মানুষের মুখ সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করো—বাবা হিসেবে এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’

পারিবারিক অসচ্ছলতার জন্য মেহেদীর বয়স যখন ৫ বছর, তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবিকার তাগিদে বরিশালের বাকেরগঞ্জ ছেড়ে খুলনায় যাই। সেখানেই ওর পড়াশোনা, শৈশব-কৈশোর কাটে। শিকড়ের টানে এখন আবার পৈতৃক ভিটায় ফিরেছি। এখানে আমার বাবার কবর। তাই জন্মভিটায় ফিরে এসেছি। নতুন বাড়ি নির্মাণ করছি।

খুব ছোটবেলা থেকেই মেহেদীর ক্রিকেটের প্রতি গভীর আগ্রহ। নারকেলগাছের ডাঁটা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে বাড়ির পাশের খেতে ব্যাট-বল নিয়ে ক্রিকেট খেলত। চার বছর বয়সে আউলিয়াপুর গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দিই। দিনের বেশির ভাগ সময় কাজের জন্য আমাকে বাইরে থাকত হতো। ছেলে পড়াশোনা করছে কি না, খোঁজ নিতে পারতাম না। একদিন আগেভাগেই বাড়িতে এসে শুনি মেহেদী স্কুলে। ইচ্ছে করেই ছেলের স্কুলে খোঁজ নিতে যাই। দেখি স্কুলে নেই। খোঁজ করে দেখি সে খেতে গিয়ে ক্রিকেট খেলছে। বাড়িতে ধরে এনে কত বকাঝকা করেছি ওইটুকু ছেলেকে। প্রায়ই সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই কাজটা করত। এরপর খুলনায় যাওয়ার পর ক্রিকেটের নেশা আরও বাড়ে, আর সেটা স্কুল ফাঁকি দিয়েই। একদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে দেখে বাড়িতে ধরে এনে বেদম মেরেছিলাম। শরীর ফুলে গিয়েছিল। মাঠে প্রশিক্ষকের কাছে যখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল, তখনো বেশ কয়েকবার মাঠ থেকে ধরে এনে ছেলেটাকে মেরেছি। আজও সেসব দিনের কথা মনে
উঠলে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। সেই মিরাজই আমার মুখ উজ্জ্বল করল।

তবে ওর মা ছেলের আগ্রহকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়েছে। সেসব সময়ের কথা ভেবে আক্ষেপ, অনুতাপ হলেও আবার এই ভেবে ভালো লাগে আমি ওর সঙ্গে যত কিছুই করেছি, ছেলেটা দমে যায়নি। সাহস নিয়ে ক্রিকেট ধরে রেখে নিজের আগ্রহে, ইচ্ছায় এত দূর এসেছে। বাবা হিসেবে ওর এই ইচ্ছা, আগ্রহ আমাকে গর্বিত করে।

বাংলাদেশের হয়ে আমাদের ছেলেরা এখন ইংল্যান্ডে আছে। সব সময় নামাজ পড়ে দোয়া করি, যেন ওরা ভালো করে। ওদের সবার জন্য হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, শুভকামনা।

অনুলিখন: এম জসীম উদ্দীন, বরিশাল