কাচসেতুর রোমাঞ্চ

কাচসেতুর পাশেই রয়েছে পাহাড়ের গা–ঘেঁষা স্বচ্ছ কাচের এই হাঁটার পথ
কাচসেতুর পাশেই রয়েছে পাহাড়ের গা–ঘেঁষা স্বচ্ছ কাচের এই হাঁটার পথ

ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলাম মহাচীনে। আমার সঙ্গে ছিল আরেক ভ্রমণকন্যা (নারী ভ্রমণকারীদের জন্য আমাদের এই বিশেষণ) শিখা। চীন দেশে পা রাখতেই আমাদের দুজনের সঙ্গে জুটল আরও একজন। বাংলাদেশি সেই কন্যা টুম্পা, চীনেই পড়াশোনা করে। তিনজনের প্রথম গন্তব্য ছিল হুনান প্রদেশের ঝাংজিয়াজি। পাহাড়ি জায়গা। এখানেই আছে অ্যাভাটার মাউন্টেইন, গ্লাস ব্রিজ আর সেই বিখ্যাত তিয়ানমেন পর্বত।

ঝাংজিয়াজি পৌঁছে বুঝলাম, এটা ছোট্ট এক শহর। ওদের দেশে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশন দিদির গাড়িতে করে হোটেলে এলাম। ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যের বাড়ি। ছাদটা টিনের চালের মতো নেমে এসে কোনার দিকে বাঁকানো। কর্মীরা যথারীতি ইংরেজি বোঝে না। টুম্পার কল্যাণে আমরা ভাষার দূরত্ব ঘোচালাম। সাততলার বারান্দা থেকেই পাহাড় হাতছানি দেয়। নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনায় ভোরে উঠেই তৈরি।

আমাদের প্রথম গন্তব্য কাচের তৈরি সেই সেতু। ৯৮০ ফুট গভীর গিরিখাতের ওপরে ১ হাজার ৪১০ ফুট দূরের দুটি পাহাড়ের চূড়াকে এক করেছে এই সেতু। পৃথিবীর শুধু দীর্ঘতম কাচের তৈরি সেতুই নয়, সর্বোচ্চ উচ্চতার খেতাবও দখল করে রেখেছে তা।

বাসস্টেশনে গিয়ে ২২ ইউয়ান (চীনা মুদ্রা) দিয়ে টিকিট কেটে রওনা দিলাম। সেদিন আমাদের আধা ঘণ্টার মতো লাগল উলিংইউয়ান এলাকায় গ্রান্ডক্যানিয়নের প্রবেশপথে পৌঁছাতে। কিছুক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠতে হয়, তারপর টিকিট ঘর। টিকিট সংগ্রহ করে কয়েকটা নিরাপত্তা ফটক পার হতে হয় (চীন নিরাপত্তার ব্যাপারে খুবই কঠোর, প্রতিটি সারি তিনবার করে তল্লাশি করে প্রবেশ করায়)। জুতার জন্য একটা লাল রঙের কভার দেয়, সেটা পরেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। ভেতরে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলাম মেঘ দেখে! মনে হচ্ছিল ব্রিজটার অর্ধেক কাজ এখনো অসম্পূর্ণ, আদতে তা ডুবে আছে মেঘের রাজ্যে। একটু উত্তেজনা, একটু ভয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কাচের সেতুর ওপর দাঁড়াতেই মনে হচ্ছিল, মেঘের ওপরেই ভেসে আছি। পায়ের নিচে স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়েও দেখি, মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে।

কাচের সেতুতে হাঁটতে মনে জোর থাকা চাই! ছবি: লেখক
কাচের সেতুতে হাঁটতে মনে জোর থাকা চাই! ছবি: লেখক

একটু মন খারাপই হলো। মেঘের জন্য অনতিদূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার, সূর্য উঁকি দিল। পায়ের নিচের থেকে মেঘ সরে যেতেই দেখি, প্রায় হাজার ফুট নিচে সূক্ষ্ম সুতার মতো নদীতে গিয়ে মিশেছে ঝরনা। এ এক আশ্চর্য সুন্দর। আমাদেরও একটু ভয় ভয় করছিল যদিও, কাচের তৈরি বলে কথা, যদি ফাটল ধরে। আশপাশে তাকাতেই মনে হলো, আমরাই বেশি সাহসী। কয়েকজনকে দেখলাম রেলিং ধরে ধরে পার হচ্ছে। কেউ কেউ আবার প্রিয়জনের হাত শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করেই পার হচ্ছে। কেউ কেউ ভয়ে নিচের দিকে তাকাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ অতি-সাহসী হয়ে পা ঠুকে দেখছে কাচ ভাঙে কি না! যদিও পাগলামিতে আমাদের জুড়ি নেই। ধুপ করে উপুড় হয়েই শুয়ে পড়লাম কাচের এই হাঁটা পথে। পরিষ্কার কাচে চিবুক ঠেকাতেই দেখা গেল ৯০০ ফুট নিচের সবুজ উপত্যকা, রুপালি সুতার মতো নদী আর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পিঁপড়ার মতো মানুষ। মনে ভাবলাম, ওই নিচে কীভাবে যাব! চুপ করে কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানে চলে গেলাম যেন। মুনি-ঋষিরা মনে হয় 

এই মৌনতার জন্যই পাহাড় বেছে নিতেন।

এরপরই আরেক পাগলামি করে বসি আমরা। বাঙালি মেয়ে, শাড়ি নিয়ে এসেছি ব্যাগে করে। শাড়িতে জড়িয়ে দাঁড়াতেই দেখি আশপাশের মানুষজন স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে আছে, এই প্রথম শাড়ি পরা কাউকে দেখল মনে হয়। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। আমাদের তো থোড়াই কেয়ার ভাব। নিজেদের মতোই ছবি তুলছিলাম। হুট করে একজন এসে পাশে দাঁড়িয়ে ফোন দিয়ে ইশারায় বলে, আমাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চায়। চীনা মানুষ ভিনদেশিদের সঙ্গে খুব ছবি তুলতে পছন্দ করে শুনেছিলাম। এবার নিজেদের বিদেশি বিদেশি লাগতে লাগল। সবাই এসে আমাদের সঙ্গে ছবি তুলল। ভয়ডর কোথায় জানি উবে গেল।

কাচের সেতুতে দেরি করলে চলবে না, পুরো গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তখনো বাকি যে। ছবি তোলায় বিরতি দিয়ে এগোলাম। মনে হলো শূন্যে ভেসে ভেসেই অন্য পাশের পাহাড়ে চলে এলাম। এবার লক্ষ্য এই ৯৮০ মিটার পাহাড়ের গা ঘেঁষে বানানো কাঠের সিঁড়ি দিয়ে খাদে নামা। হাজারখানেক ধাপ। কখনো পাহাড়ের গায়ের সঙ্গে, কখনোবা গুহার ভেতর দিয়ে। মাঝেমধ্যে এমন সরু যে একজনের বেশি একসঙ্গে নামা যায় না। ওরা একে বলে আকাশসিঁড়ি। নামতে নামতে রাবণের কথা মনে হচ্ছিল। লঙ্কারাজ রাবণ একসময় নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, স্বর্গে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি বানাবেন। বানালে বুঝি এমনটাই হতো।

কেউ যদি এত সিঁড়ি না নামতে চায়, তারা ২২ ইউয়ানের বিনিময়ে এলিভেটর দিয়ে নামিয়ে দেবে অর্ধেকটা পথ। পাহাড়ের গা ছুঁয়ে, নিচে পাথরের গায়ে আছড়ে পড়া ‘ফ্লাইং ফক্স’ ঝরনার শব্দ কানে নিয়ে হাজারখানেক ধাপের সিঁড়ি পার হয়ে পৌঁছালাম ঝরনার কাছে। ছিটে আসা পানিতে ভিজে এবার সেই পাহাড়ি নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা। হাঁটতে হাঁটতে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। শব্দহীনতা যেন সৌন্দর্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কখনো গুহার ভেতর দিয়ে, কখনোবা নদীর পাশের কাঠের ব্রিজ দিয়ে হেঁটে পৌঁছালাম এক নীল–সবুজ হ্রদে। কাঠের তৈরি নৌকা আমাদেরই অপেক্ষায় ছিল সভ্যতার মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। তাতে কী, এই সবুজ সুন্দরের নেশার অনুভূতি ইট–কাঠের মধ্যেও অক্সিজেন দেবে।