এক টুকরো রত্নের খোঁজে

টিপু সুলতান। ছবি: সংগৃহীত
টিপু সুলতান। ছবি: সংগৃহীত

গত শতকের আশি বা নব্বইয়ের দশকে বা এর একটু আগে–পরে যাদের জন্ম, সেই সময়ের ছেলেমেয়েরা বা আমরা আজকাল মাঝেমধ্যেই বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে যাই এই ইট-পাথরের সঙ্গে মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে। খুঁজে ফিরি ধূসর কৈশোর। এখন সময়ের অভাবে টেলিভিশন দেখা না হলেও তখন টেলিভিশন দেখার জন্য যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল, সেটা মনে হলে কেমন যেন একটা অনুভূতি হয় এখনো।

আমাদের সেই সময়ে টিভিতে নানা সাপ্তাহিক সিরিয়ালের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় ছিল শের-এ-মহীশুর টিপু সুলতানের সিরিয়াল। কী ভীষণ রোমাঞ্চ যে খেলা করে যেত একেকটা পর্বে, সেটা আমরা যারা সেই সময়ের এই সিরিয়ালের জন্য সপ্তাহ ধরে অধীর অপেক্ষা করতাম, তারাই শুধু জানি। তো কৈশোরের সেসব দিন তো সে কবেই আধুনিক আগুনে জীবনের ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে, নিজেই সে খেয়াল রাখতে পারিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের নানা প্রান্তের বিভিন্ন জিনিস দেখার নেশার মধ্যে একদিন হুট করেই মনে পড়ল কৈশোরের সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। একে একে ভারতের অনেক প্রদেশ দেখে ফেলার পর একদিন তালিকায় হায়দরাবাদ আর মহীশুরের মতো ঐতিহাসিক শহরের নাম চলে এল। আর তখনই মনে পড়ে গেল শের-এ-মহীশুর টিপু সুলতানকে নিয়ে দেখা সেই টেলিভিশন ধারাবাহিকের কথা। আমরা যেটাকে মহীশুর নামে জানতাম, সেটাই আজকের মাইশুর।

টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। ছবি: লেখক
টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। ছবি: লেখক

স্মৃতিকাতর হয়ে একদিন ঠিক করলাম, আমার পরের গন্তব্য হবে মহীশুর, যেখানে রয়েছে ইতিহাস আর টিপু সুলতানের স্মৃতি। পাহাড়-বন-সমুদ্র দেখে ফেলার পর ছেলেবেলার নায়ক টিপু সুলতানের স্মৃতি একটু ছুঁয়ে না দেখলে অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যাবে জীবন।

ইট, বালু, মাটি, পাথর, কাঠ, দেয়াল, জং ধরা কার্নিশ, পলেস্তারা খসে পড়া ছাদ, মাকড়সার জালভর্তি ঝাড়বাতি, পুরোনো লন্ঠন—এই সবকিছু নিয়ে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ একদিন ধরা দিল আমার সামনে।

বেশ অল্প সময় নিয়ে গিয়েছিলাম টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদে। এটি তাঁর মূল প্রাসাদ থেকে একটু দূরে, বেশ খোলামেলা জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছিল। কর্ণাটক রাজ্যে গরমের সময় প্রচণ্ড গরম পড়ে বলে একটু নিরিবিলি আর আরামে থাকার জন্য কাঠ দিয়েই বানানো হয়েছে এই প্রাসাদের অধিকাংশ। অবশ্য রাজ্য পরিচালনার কাজও তিনি করতেন এখানে বসে। তবে সেসব ইতিহাস এখানে না হয় থাক। শুধু এই প্রাসাদের অপূর্ব নির্মাণশৈলী, কারুকাজ, স্থাপত্য সৌন্দর্য, শিল্প ও সংস্কৃতির যে ছোঁয়া তিনি রেখেছেন স্থাপনাজুড়ে, আজ সেটুকুই না হয় বলি।

প্রাসাদের সামনে গিয়ে যদিও প্রথমে আমি বেশ হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম; কারণ এটি ঠিক প্রচলিত প্রাসাদের মতো তেমন বিশাল, জমকালো, ঝকঝকে কিছু নয়। একটা প্রাচীন ভঙ্গুর, পলেস্তারা খসে পড়া মাঝারি আকারের সাদা আর মেটে রঙের বাড়ি। দেয়ালে কিছু ঝুলন্ত প্রাচীন দরজার মতো, যার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায়, আগের আমলে কনে দেখার সময় বা অন্দরমহলে যে আলতো আড়াল থাকত, তেমন কিছু। হতাশা নিয়েই ভেতরে ঢুকে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম পুরোনো বাড়ি বা প্রাসাদের শুধু কারুকাজ দেখেই।

প্রাসাদের টানা বারান্দা। ছবি: লেখক
প্রাসাদের টানা বারান্দা। ছবি: লেখক

এত অপূর্ব, এত বনেদি আর এতটাই জমকালো তার অন্দর, অন্দরের চারপাশ, দেয়াল, ছাদ, দরজা, জানালা, বারান্দা, বেলকনি, আসবাব, ছবি আর টিপু সুলতানের ব্যবহার করা সবকিছু! মুগ্ধ না হয়ে পারা গেল না কিছুতেই। এমনই তার জৌলুশ, এতটাই তার রূপ, এমন অপরূপ চারদিক আর সবকিছুর কারুকাজ সে প্রাসাদের যে কী বলব!

এত সূক্ষ্ম কাজ, রঙের ব্যবহার, এত আদুরে শিল্পের ছোঁয়া, এত কোমল, নিখুঁত আর আবেগপ্রবণ সবকিছু—আমি বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। বিশাল খোলা বারান্দা প্রাসাদের চারপাশে। দোতলা এই প্রাসাদের প্রতিটি জানালার সঙ্গে ঝুলে থাকা বেলকনিগুলো নান্দনিক আর অভিজাত। বিশাল বিশাল দেয়ালের প্রাচীরে নানা রকম বাণী খচিত। পুরো প্রাসাদের চারদিকেই সবুজের মখমল বিছানো কোমল ঘাস, মাঝেমধ্যে নানা রকম রঙের ফুলের হাসি আর ফোয়ারার উচ্ছ্বাস, বিশাল বিশাল গাছ। কোথাও কোথাও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কামান ও গোলা–বারুদের অবস্থান আর দূরে উঁচু প্রাচীর বুঝিয়ে দিচ্ছিল সেই সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

সময় এত অল্প ছিল যে আমি দেখব না ছবি তুলব, নাকি নিজের মতো করে চুপচাপ আর একাকী অনুভব করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

না, আর দেরি করা যাবে না। আমাকে ফিরতে হবে অতীত ইতিহাসে ডুবে থাকা এই প্রাসাদ থেকে। পথ ধরলাম ফেরার। বারবার পেছন থেকে ইতিহাসের এক জেগে থাকা প্রাঙ্গণ আমাকে হাতছানি দিচ্ছে।

কামান। ছবি: লেখক
কামান। ছবি: লেখক

এমন রোমাঞ্চকর ইতিহাসের সামনে গিয়ে বাস্তবে সেই সময়ের স্মৃতিকে উপভোগ করতে হলে যেতে হবে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মহীশুরে। ভারতের কলকাতা থেকে ট্রেন বা প্লেনে মাইশুর গিয়ে মূল শহর থেকে আরও ২৫ কিলোমিটার দূরের শ্রীরামপুরে যেতে হবে টিপু সুলতানের এই গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ দেখতে।