শিশুর সুরক্ষায়

সন্তানের অভিভাবক হিসেবে যে বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই মাথায় আনতে চাই না, সেটা হলো সন্তানের শরীরে যৌনতার আঘাত। সমাজবিশ্লেষকেরা বলছেন, আত্মীয়-বন্ধু-শিক্ষক, প্রতিবেশী যেকোনো মানুষের কাছ থেকেই আসতে পারে এ নির্যাতন। এ যৌন আঘাত শরীরের ব্যক্তিগত অংশে অযাচিতভাবে যৌন স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা হতে পারে।

অস্বস্তিকর হলেও সত্য, শিশুদের এ ধরনের নির্যাতন বাইরের মানুষের চেয়ে পরিবার বা কাছের মানুষের কাছ থেকে বেশি হয়ে থাকে। শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, ছেলেশিশুরাও একইভাবে নির্যাতিত হয়। সুতরাং ভালো বা মন্দ স্পর্শ সম্পর্কে ছেলেমেয়ে উভয়কেই ধারণা দিন। প্রশ্ন হলো, কীভাবে নিরাপদ রাখব শিশুর শরীর?

শিশুকে তার শরীর সম্পর্কে ধারণা দিন
শিশুকে জানান শরীর একান্তই তার নিজস্ব এবং সম্পূর্ণই তার আয়ত্তাধীন। কোন আদর সে কতটুকু গ্রহণ করবে বা করবে না, সেটার সম্পূর্ণ অধিকার তার এবং যেকোনো সময় যেকোনো আদরকে সে ‘না’ বলতে পারে। এমনকি কোনো ভালো স্পর্শ কোনো মুহূর্তে ভালো না লাগলেও আদর গ্রহণ না করার অধিকার সে রাখে।

শিশুকে ব্যক্তিগত অংশসহ তার শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম শেখান। নাম জানা থাকলে সে এসব অংশ নিয়ে বিব্রত থাকে না। ফলে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে সে অন্যের কাছে সহজে বলতে পারবে। 

অনিরাপদ আদর সম্পর্কে জানান

● দু-তিন বছর থেকেই শিশুকে অনিরাপদ স্পর্শ সম্পর্কে ধারণা দিন। 

● শিশুকে স্পষ্ট করে জানান বড়দের (সে যে–ই হোক না কেন) কোনো আদর তার কাছে অস্বস্তিকর, খারাপ বা ভীতিকর লাগলে সেটা যেন তার অভিভাবককে সঙ্গে সঙ্গে জানায়। 

● শরীরের কিছু অংশ, বিশেষ করে বুক, নিপল, হিপ (পশ্চাদ্দেশ), যৌনাঙ্গ, ঠোঁট একান্তই তার নিজস্ব। একান্ত নিজস্ব অংশে অন্য কারও আদরও (এমনকি খেলাচ্ছলে হলেও) অনিরাপদ বা মন্দ আদর হতে পারে।

● যে আদর করার পর ভয় দেখানো হয়, ভিডিও করা হয় বা অন্যের কাছে বলার জন্য মানা করা হয় বা যা একান্ত গোপন খেলা হিসেবে বলা হয়, সেসব আদর বিষয়ে সতর্ক করুন। শিশুকে দৃঢ়ভাবে ‘না’ বলতে শেখান এবং সেখান থেকে যেভাবেই হোক সরে আসতে বলুন।

● কোনো ব্যক্তির আদর খারাপ লাগলে, পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে যেন কখনোই শিশু একা না থাকে, সেটা নিশ্চিত করুন। 

তবে অনিরাপদ স্পর্শের বিষয় এমনভাবে বলবেন না, যাতে সাধারণ আদর সম্পর্কেই শিশুর নেতিবাচক ধারণা হয় বা শরীর নিয়ে অহেতুক ভীতির সৃষ্টি হয় অথবা মানুষ সম্পর্কে একরকম অবিশ্বাস তৈরি হয়। মনে রাখবেন, শরীর নিয়ে নিজস্ব ধারণার সঙ্গে আমাদের আত্মবিশ্বাস গভীরভাবে জড়িত। 

শিশুকে সামাজিকভাবে দক্ষ করে তুলুন

অনেক অভিভাবক শিশুর নিরাপত্তার ভয়ে কারও সঙ্গে মিশতে না দিয়ে অতিরিক্ত আগলে রাখেন। মনে রাখা প্রয়োজন, যেকোনো সামাজিক মেলামেশা, খেলাধুলা, নানা ধরনের মানুষের সাহচর্য শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, সমস্যা মোকাবিলার দক্ষতা তৈরি হয়, মানুষ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়। সুতরাং শিশুকে কারও সঙ্গে মিশতে না দিলে তার মধ্যে যে শুধু চাপ সহজে মোকাবিলা করতে পারার দক্ষতা কম থাকে তা–ই নয়, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নেতিবাচক মানসিক প্রভাবও তার মধ্যে অনেক বেশি হয়। দেখা গেছে, অতিরিক্ত আগলে রেখে বড় হওয়া শিশুরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের নেতিবাচক প্রবৃত্তি ও বিকৃত মানসিকতার শিকার বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী শিশুর সরলতা, সামাজিক অদক্ষতার সুযোগ বেশি নেয়। 

আপনার নজরে থাকুক শিশুর বেড়ে ওঠা

আপনার সন্তান কখনো এমন কোথাও থাকবে না বা এমন কারও কাছে থাকবে না, যা আপনার জানা নেই। অর্থাৎ সন্তান কার কাছে আছে, কোথায় আছে, কোথায় খেলছে, সেটা যেন আপনার জানা থাকে। এ ছাড়া অপরিচিত বা স্বল্প চেনা মানুষের কাছে বাচ্চা দীর্ঘ সময়ের জন্য একা ছেড়ে যাবেন না। 

যৌন নির্যাতন যেমন শিশুদের মানসিক বিকাশে অন্যতম অন্তরায়, তেমনি প্রয়োজনীয় সামাজিক মেলামেশা না করতে দেওয়াও শিশুকে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখবেন, নিরাপত্তার নামে আপনার শিশুকে সব সময় আগলে রাখলে ভবিষ্যতে আপনার সন্তানের সবচেয়ে অনিরাপদ থাকার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং সন্তানকে আপনার নজরদারির মাধ্যমে সবার সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে দিন। 

মেখলা সরকার
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।