বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে

নানা কারণে বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হতে পারে। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাই ভালো। মডেল: প্রিয়তা ও প্রেরনা। সাজ: ক্লিওপেট্রা বিউটি স্যালন। ছবি: খালেদ সরকার
নানা কারণে বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হতে পারে। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করাই ভালো। মডেল: প্রিয়তা ও প্রেরনা। সাজ: ক্লিওপেট্রা বিউটি স্যালন। ছবি: খালেদ সরকার

বলা হয়, বোন থাকা মানে সারা জীবনের জন্যই একজন বন্ধু থাকা। দুই বোনের মধ্যকার সম্পর্ক যেন পৃথিবীর অনেক সম্পর্ককে হার মানায়। দুজনে সুখে-দুঃখে থাকে পাশে, মনের বাতি হয়ে। এ এক মায়াময় সম্পর্ক। সামাজিক রীতিনীতি, পারিপার্শ্বিক চাপ অনেক সময়ই দুই বোনের সুসম্পর্ক ধরে রাখতে পারে না। বিশেষ করে বড় বোনের আগে যদি ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যায়। যেমনটা হয়েছে সোমা ও রত্নার (ছদ্মনাম) জীবনে।

ছোট বোন সোমাকে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন রত্না। ছয় বছরের ছোট এই বোনকে একরকম পুতুলের মতোই আদর-যত্নে কোলে-পিঠে করে বড় করেছেন। একসময় রত্নার আগে সোমার বিয়ে হয়। সোমা একজনকে ভালোবাসতেন, বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হতে থাকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা-বাবা বড় মেয়েটির আগে ছোট মেয়েটির বিয়ে দেন। সোমা আগে বিয়ে করায় রত্নার মনে ক্ষোভ জন্মে না ঠিকই, তবে আশপাশের মানুষের কানাঘুষায় তাঁর মনে একটা কষ্ট জমতে থাকে। চারদিক থেকে চাপ আসায় রত্না একসময় বিষণ্ন হয়ে পড়েন।

তবে রত্নার মতো নীরবে কষ্ট চেপে রাখেননি কৃতি ও মায়া। পিঠাপিঠি দুই বোন তাঁরা। বড় বোন কৃতি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরি করছেন। পাত্র দেখাদেখি চলছে বেশ অনেক দিন ধরেই, তবে ব্যাটে-বলে মিলছে না। অন্যদিকে মায়াও মানসিকভাবে প্রস্তুত বিয়ের জন্য। একজন মনের মানুষও আছে তাঁর। ছেলেটি দেশে পড়াশোনা শেষ করে বাইরে চলে যাচ্ছে। বিয়ে করে যেতে চান। দুই পরিবারও রাজি। তবে সব আটকে আছে কৃতির কারণে। বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে চান না মা-বাবা। মানুষ কী বলবে? যদি বড় মেয়ের আর বিয়ে না হয়। এই জটিলতা দুই বোনের সম্পর্কে ফাটল ধরায়। বদলে যেতে থাকেন দুজন। এমন পরিস্থিতির জন্য একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন। একসময় দুই বোনের মধ্যে কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়।

অনেক ক্ষেত্রেই এমন নেতিবাচক ঘটনা হয়তো ঘটে না। ছোট বোনের পর বড় বোন দিব্যি বিয়ে করে সংসার করছেন, ভালো আছেন—এমন উদাহরণও আছে।

আসলে সমাজ অনেক বিষয় মাথায় গেঁথে দেয়। পরিবারের বড় মেয়ের বিয়ে হবে আগে, এমন বিষয়গুলো সামাজিক রীতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। উল্টোটা হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের দিক থেকে সহযোগিতা থাকলেও অনেক সময় পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক আচরণের কারণে দুই বোনই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। সাধারণত বড় মেয়েটিকে আশপাশের মানুষের কথা বেশি শুনতে হয়। মেয়েও অনেক সময় বিষয়টি সামলে নিতে পারেন না। একাকিত্বে ভোগেন। বিষণ্নতায় ভুল কিছু করে ফেলেন। তবে এসব আচরণ-কথাকে গুরুত্ব না দেওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।

ছোট বোন কান্তার বিয়ের কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব আয়োজনই করেছেন বড় বোন রেশমা। রেশমা এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নন। অন্যদিকে কান্তা চাইছিলেন বিয়ে করতে। তাই পরিবারের সদস্যরা দুই বোনের মতামত নিয়েই বিয়ের আয়োজন করেন। ধুমধাম করে বিয়ে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেক কাছের মানুষই বিষয়টি ভালোভাবে দেখেননি। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন রেশমা। তিনি বলেন, ‘বিয়ে হলো দুটো মানুষের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরির সেতু। এই সেতুর ভিত দৃঢ় না হলে তা একসময় ভেঙে যায়। তাই পারিপার্শ্বিক চাপে, তাড়াহুড়ো করে সম্পর্ক তৈরি করার কোনো আগ্রহ নেই আমার। পরিবারও আমার মতামতকে সম্মান করেছে।’

কান্তা ও রেশমার বাবা আফসারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আসলে আমাদের দুই মেয়েরই ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা চাইনি কারও মনে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে। রেশমা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। অন্যদিকে কান্তা বিয়ে করতে চাইছিল। তাই ওদের মতামত নিয়েই এগিয়েছি আমরা।’

এমনটিই আসলে করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে পরিবারগুলোর উচিত দুই বোনের মধ্যে আস্থা তৈরি করা। বড় বোনেরও উচিত এ বিষয়ে উদারভাবে বিবেচনা করা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে বাস্তবতা দুই রকম। এক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় মেয়েটি সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল, পড়ালেখা করছেন,
কোনো সম্পর্কে জড়াতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে ছোট মেয়েটি সেভাবে পারিবারিক চাপ অনুভব করেন না বা অন্য কোনো কারণেই হোক সম্পর্কে জড়ান। ছোট মেয়েটির বিয়ে দিতে বাধ্য হয় পরিবার।

আরেকটি বাস্তবতার কথাও বললেন মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন, ‘দেখা যায়, ছোট মেয়েটি বড় মেয়েটির চেয়ে দেখতে সুন্দর। তাই ছোটটির তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল। তবে আমাদের দেশে এখনো বেশির ভাগ পরিবারই চায় না এই রীতি ভাঙতে। সামাজিক চাপে পড়তে চায় না মানুষ। বড় মেয়েকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়, হয়তো তাঁর কোনো খুঁত আছে? পারিবারিক বন্ধনে একটা টানাপোড়েন দেখা যায়।’

খুশির মুহূর্তগুলো উদ্‌যাপন করা উচিত
খুশির মুহূর্তগুলো উদ্‌যাপন করা উচিত

অনেক সময় বিয়ে না হওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যরাও বড় মেয়েকে দোষারোপ করেন। এটা ওই পরিবারের নিচু মানের সংস্কৃতির বিষয়টি নির্দেশ করে, যা হওয়া উচিত নয়। এমনটাই মনে করেন মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন। তাঁর মতে, পরিবারগুলোর উচিত, সমাজের উচিত দুটি মেয়ের মধ্যেই আস্থা তৈরি করা। পাশে দাঁড়ানো। বড় মেয়ে বিয়েতে আগ্রহী না হলে তাঁর আগ্রহের কাজে তাঁকে উৎসাহিত
করা। সুন্দর-অসুন্দরের বিষয়টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা। মেয়েটিকেও ভাবতে হবে বিয়েই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আবার ছোট মেয়েকেও নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা যাবে না। আমাদের সমাজে এ বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে। অনেক সময় এ ধরনের ঘটনায় বড় মেয়েটি একাকিত্বে ভোগেন। একেবারে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সবার সামনে আসায় নিজেকে নিয়ে ভীত হয়ে
পড়েন। এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং করা উচিত।

দেখা যাচ্ছে, এ রকম বিষয়ে দুই বোন কিংবা পরিবারের মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা হয়তো তৈরি হতো না, যদি পারিপার্শ্বিক চাপ না থাকত। দুই বোন ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকলে যাঁর বিয়েই আগে হোক, সম্পর্কটা মধুরই থাকবে।