ইলিশই সেরা

বাজারমূল্য, পুষ্টিগুণ—সব দিক থেকেই মাছের রাজা ইলিশই। ছবি: নকশা
বাজারমূল্য, পুষ্টিগুণ—সব দিক থেকেই মাছের রাজা ইলিশই। ছবি: নকশা

তুমুল বর্ষণ বা ইলশে গুঁড়ি, বর্ষার ধরন যা–ই হোক না কেন, বাঙালি মনে বর্ষার সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক যেন জোড়া লেগে গেছে। সরকারি হিসাবে চকচকে রুপালি এই মাছ এবার ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ। মূল্য ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ইলিশের বাজারমূল্যই সব নয়। আরও অনেক বিষয়ের গুরুত্বের কথাও এখন আলোচনায় আসছে, যা পরিচিত খাদ্যবহির্ভূত মূল্য (নন-কনজাম্পটিভ ভ্যালু)।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি), বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ যৌথভাবে ইলিশের খাদ্যবহির্ভূত মূল্য নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য ছাড়াও ইলিশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জীবিকা সৃষ্টির মূল্য রয়েছে। একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইলিশের এই চারটি বিষয়ের আর্থিক মূল্যমান পরিমাপ করেছে তারা। তাতে এর খাদ্যবহির্ভূত গুরুত্বের মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থাগুলো বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে ইলিশ। শুধু আর্থিক বা খাবারমূল্যে নয়, সামাজিক–সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও জীবনযাত্রার দিক থেকেও ইলিশ এই উপমহাদেশের সেরা মাছ।

ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ এবং দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে (জিডিপি) ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। ভিয়েতনাম থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি থাকলেও বাংলাদেশেবিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে (৫০-৬০ শতাংশ)। পাশাপাশি মিয়ানমারে ২০-২৫ শতাংশ, ভারতে ১৫-২০ শতাংশ এবং অন্য কয়েকটি দেশে ৫-১০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর দেশে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ, আয়তন ও ওজন বেড়েছে। ফলে ইলিশের দামও গত এক বছরে কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। একসময় যে ইলিশ হয়ে গিয়েছিল উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনীদের আহার, তা গত বছর মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমায় চলে এসেছে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ১ লাখ টন বেড়ে ৫ লাখ টন হয়েছিল।

বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের কাছে ইলিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ওডিশা, বিহার ও আসামেও বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে ইলিশের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পয়লা বৈশাখ, জামাইষষ্ঠী ও পূজায় ইলিশ মাছ খাওয়া অনেকটাই জনপ্রিয় রীতি।

পুষ্টিমানেও এগিয়ে

ওয়ার্ল্ড ফিশের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ৩০টি জনপ্রিয় মাছের পুষ্টিগুণ নিয়ে ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে পুষ্টিকর মাছ হচ্ছে ইলিশ। ইলিশের পুষ্টিগুণের বিস্তারিত হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ১ হাজার ২০ কিলোজুল (শক্তির একক) শক্তি থাকে। তাতে ১৮ থেকে ২২ গ্রাম চর্বি, ২২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১৪ দশমিক ৪ গ্রাম প্রোটিন, ২ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম লৌহ, সামগ্রিক ফ্যাটি অ্যাসিডের ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশ ওমেগা-৩ থাকে।

শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রায় ২৬ কোটি মানুষ ইলিশ মাছ খায়। স্যামন ও টুনার পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় মাছ হচ্ছে ইলিশ। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরেই ইলিশের অবস্থান।

বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ইলিশের পুষ্টিগুণের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ইলিশ মাছে ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কম থাকে। ফলে হৃদ্‌যন্ত্র থাকে সুস্থ। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। এ ছাড়া ভিটামিন এ ও ডির উৎকৃষ্ট উৎস ইলিশ। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল, বাঙালির ইলিশই তো সেরা।