ঘরোয়া খেলায় পরিবারের আনন্দ

দাবার মতো ঘরোয়া খেলা আনন্দের পাশাপাশি পরিবারের বন্ধন জোড়ালো করে। মডেল: শারমিন, মহিউদ্দিন আকরাম ও অহনা। ছবি: কবির হোসেন
দাবার মতো ঘরোয়া খেলা আনন্দের পাশাপাশি পরিবারের বন্ধন জোড়ালো করে। মডেল: শারমিন, মহিউদ্দিন আকরাম ও অহনা। ছবি: কবির হোসেন

এখন শ্রাবণ মাস। প্রকৃতির খেলায় কখনো হচ্ছে ঝুমবৃষ্টি, কখনোবা কটকটে রোদ। অতিবৃষ্টিতে প্রায়ই রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাচ্ছে। বন্যাতেও প্লাবিত দেশের অনেক জায়গা। পানিবন্দী হয়ে পড়ছে মানুষ। প্রায়ই বৃষ্টির জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুল–কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয় না। বাসার সামনে পানি ওঠায় অনেককেই বাদ দিতে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা। এমন অবস্থায় ঘরে বসে পরিবারের সঙ্গেই কাটিয়ে নেওয়া যেতে পারে একটা সুন্দর সময়। আর তা স্মার্টফোনের পর্দায় না, ঘরোয়া কিছু খেলাধুলার মাধ্যমে। এতে সময় যেমন কাটবে আনন্দে, তেমনই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধনটাও হবে জোরালো।

আসলে যান্ত্রিক জীবনে প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর খুব একটা সময় পাই না আমরা। তাই ঝুমবৃষ্টির জন্য আটকা পড়লে বা বাইরে যেতে না পারলে, বিষণ্ন সময়টাকে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে কিছুটা উষ্ণ করে তোলা যায়। কিছুদিন আগে ঢাকায় টানা বৃষ্টির কারণে মাহিনদের বাসার সামনে পানি জমে যায়। নোংরা পানি পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে মন চাইছিল না মাহিনের। তাই অগত্যা বাসাতেই থাকতে হলো তাঁকে। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে মা আর ছোট বোনের সঙ্গে সময়টা খুব সুন্দরভাবে কাটান মাহিন। বেশ কয়েকটা রান্না শিখে ফেলেন তিনি। রাতের বেলা জম্পেশ আড্ডা আর লুডু খেলা। অনেক দিন পর এত আনন্দ করেন তিনি।

তবে মাহিনের মতো চমৎকার একটা সময় কাটানোর সুযোগ তৈরি হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শফিক আহমেদ পানিবন্দী হয়ে সময়টা কাটিয়েছেন বড্ড এলোমেলোভাবে। পুরো সময় মুঠোফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করেই কেটেছে তাঁর। তাঁর স্ত্রী শিলা বেশ বিরক্ত হয়েছেন শফিকের আচরণে। বললেন, ‘প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে দুজনই অফিসে যেতে পারিনি। পুরোটা সময় সে ঘরে মোবাইল ধরে কাটাল। এমনিতেই দেখা হয় কম। দুজনের ডে অফও ভিন্ন দিনে। এক দিন সুযোগ মিলল অথচ কথাই হলো না কোনো।’ শফিক আহমেদ বললেন, ‘বৃষ্টি, বাসার নিচে পানি। অফিসে যেতে না পারায় খুব অস্থিরতা ছিল মনে।’

একই রকম তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বললেন ফারহানা। ঢাকার বাইরে থাকেন তিনি। বাসার সামনে পানি উঠেছে। এমনকি ঘরের দুটো সিঁড়ি ডুবে গেছে। দুই মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না। কী করব, কী করব করে সারাক্ষণ বিরক্ত করছে। ফারহানা বলেন, কীভাবে ওদের একটু খুশিতে রাখব বুঝে উঠতে পারি না। হাতে মোবাইল দিয়ে দিয়েছি। সেটা দিয়েই খেলছে ওরা।

তবে এমনটা হওয়া উচিত নয়। এমন দিনে সারাক্ষণ মোবাইল ফোন বা টিভি দেখে সময় কাটানো ঠিক নয়। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে হালকা ধরনের খেলাধুলা করে সময় কাটালে সময়টাও ভালো যায়, পারিবারিক বন্ধনটাও সুদৃঢ় হয়। খেলা যে শুধু মাঠেই খেলতে হয়, এমন কোনো কথা নেই। এ সময়ে সবাই মিলে ঘরোয়া খেলা যেমন দাবা, লুডু, ক্যারম, ডার্ট বোর্ডের মতো খেলায় মেতে ওঠা যায়। তাই বাসায় খেলার এই সরঞ্জামগুলো থাকলে সময় কাটানো সহজ হয়।

এমনিতেই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের মনে একটা বিষণ্ন অনুভূতি নিয়ে আসে। প্রয়োজন অথচ বাইরে যেতে পারছি না—এমন অনুভূতি মনের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করে। এমন অবস্থায় স্বস্তি দেয় ঘরোয়া খেলাধুলা। এর মাধ্যমে পরিবারের সবার পাশাপাশি ছোটরাও বড়দের সান্নিধ্যে থাকতে পারে। আসলে কেবল এ সময় নয়, সুযোগ পেলেই পরিবারের সদস্যরা যদি একসঙ্গে গল্প, হালকা খেলাধুলা, একসঙ্গে সিনেমা দেখার মতো কাজগুলো করেন, তবে চাপে থাকলেও তা মনে কিছুটা সতেজ অনুভূতি এনে দিতে পারে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, একেকজনের একেক রকম কর্মক্ষেত্র, সন্তানদের স্কুল–কলেজ সব মিলিয়ে এখনকার যুগে একে অপরকে সময় দেয় কম। কোনো কারণে যদি একটু সময় পাওয়া যায়, তবে তার পুরোটা কাজে লাগানো উচিত। অনেক কথা বলার সময় হয় না। এমন দিনে বলে ফেলা যায়। এমন দিনে মন বিষণ্ন হয়, কখনো কখনো হতাশাও চলে আসে মনে। একসঙ্গে ঘরোয়া খেলা, বিশেষ রান্না করে সময় কাটানো যায়। দেখা যায় পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে আমাদের কথা বলার সময় হয় না। বাচ্চারাও পড়াশোনার চাপে কাছে যাওয়ার সুযোগ পায় না। একটু সময় পেলে তাদের অভিজ্ঞতাগুলো শোনা যায়। এতে বাচ্চাদের মধ্যে নীতি বোধ শেখানো যায়।

এখন মানুষ সময় পেলেই ফোন, টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যাপক সামাজিক যোগাযোগ রাখতে গিয়ে ঘরের সামাজিকতাটাই হয় না, একে অপরের কথা শোনে না। সুলতানা মোস্তফা খানম বলেন, আমরা এমন দিনে নিয়ম করতে পারি যে, কোনো ফোন ধরা যাবে না। নিজেরা সময় কাটাব। দেখা যায় কেবল বাচ্চারা নয় বাবা–মায়েরাও ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকেন। বাচ্চারা করার কিছু না পেয়ে অভিমান করে। তাই পরিবারের বড় সদস্যদের এগুলো বুঝে নিজেদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে।