ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

বর্ষার বৃষ্টিতে হৃদয় যেন বলে, চলো ভিজি। মডেল: লাবণ্য ও রিয়াদ। ছবি: সুমন ইউসুফ
বর্ষার বৃষ্টিতে হৃদয় যেন বলে, চলো ভিজি। মডেল: লাবণ্য ও রিয়াদ। ছবি: সুমন ইউসুফ
>চিরকালই বৃষ্টি হৃদয়ে সৃষ্টি করে কথা। তাই হয়তো প্রেমে ব্যাকুল হয়ে আমরা স্পর্শ করতে চাই প্রেয়সীর হাত, সেই মানসীর উদ্দেশে কখনো কখনো কবিও হয়ে উঠি। নাগরিক জীবনে বর্ষার বৃষ্টিতে হয়তো ভেজার সুযোগ হয় না, তবু হয়তো কেউ বলে, ‘চলো ভিজি’।

অফিস থেকে বাইরে তাকিয়ে সেদিন খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। বাইরে ঝুমবৃষ্টি, অফিসের স্বচ্ছ কাচের ভেতর থেকে দেখছিলাম পানির তোড়। মনে হলো, আকাশ কি ফুটো হয়ে গেল! এই বৃষ্টি মন উথাল করা, এই বৃষ্টি মন কেমন করা। বর্ষা কত কিছু মনে করায়! বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, সে সময় এমন ঝরো ঝরো বর্ষায় আমরা কি হলে, আমাদের রুমে থাকতাম? বৃষ্টিতে ভিজতাম এবং ভিজতাম।

বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মাথার ওপরে কোনো ছাতা নেই। যখন সঙ্গে থাকে প্রিয় মানুষ, ছাতার মতো বাড়তি একটি বস্তু তখন কে আর সঙ্গে রাখে! স্মৃতিগুলো কয়েক বছর আগের, ছাত্রজীবনের। তবু তা বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে পুরোনো হয়নি একটুও। সে সময় ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিন শুরু হলে অবধারিতভাবে আমার মুঠোফোনেও উড়ে আসত বৃষ্টি, ‘রিমঝিম শুরু হয়েছে, চল ভিজি।’

তার—মেয়েটির এই এক টুকরো খুদে বার্তার অপেক্ষা। তারপর ঘন বর্ষণ মাথায় করে তার সঙ্গে ক্যাম্পাসের এমাথা–ওমাথা চষে বেড়ানো। বৃষ্টিভেজা পিচঢালা পথ ধরে আমরা ঘুরছি আর আমাদের মুখে মহিনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের গান: ‘শহরের উষ্ণতম দিনে, পিচগলা রোদ্দুরে বৃষ্টির বিশ্বাস তোমায় দিলাম আজ...’

বৃষ্টির বিশ্বাস আজও ভিজিয়ে দেয় আমাদের। এখন এই ১০টা–৫টার কর্মব্যস্ত দিনে বাস্তবে ভিজতে না পারলেও মনে মনে আমরা ঠিকই ভিজি। আর রবীন্দ্রনাথের মতো করে কেবলই আমাদের মনে হয়, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

বাঙালির এই এক ব্যাপার, ষড়্‌ঋতুর বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুই তার মনে প্রভাব রেখে যায়। ফলে বর্ষাকালে ব্যস্ত নগরজীবনে যদি ছিটেফোঁটা বৃষ্টির দেখাও মেলে, বাঙালির মন কেমন করে ওঠে। তবে এখন ঋতুচক্রের মতিগতি বোঝাও দায়। বর্ষার দিনে বৃষ্টির দেখা নেই অথবা বৃষ্টি শুরু হলো বর্ষার মাঝামাঝি এসে—কয়েক বছর ধরে হরহামেশা এমনই ঘটছে।

কিন্তু এই নাগরিক জীবনে আকাশ মেঘলা হলেই ভিজে ওঠে আমাদের মন। তাই বৃষ্টি আসার আগে আগ বাড়িয়ে ফেসবুকের নিউজফিডে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামিয়ে ফেলি আমরা। আমাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, তাঁর ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ থেকে শুরু করে ‘বাদল–দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান’—কত কত উদ্ধৃতিতে ঝলমলিয়ে ওঠে ফেসবুক!

শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নয়, অঞ্জন দত্তর ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি, বৃষ্টির ছবি এঁকেছি’ থেকে শুরু করে পার্থ বড়ুয়ার ‘বৃষ্টি দেখে অনেক কেঁদেছি, করেছি কতই আর্তনাদ, দুচোখের জলে ভাসাব বলে, তোমাকে আজ কাঁদাব বলে’—এসব গান বৃষ্টির দিনে বিভিন্নজন যখন নিজের নিজের অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন, আমাদের মধ্যে আছড়ে পড়ে এক পশলা স্মৃতির বৃষ্টি। যেমন, এই বর্ষার এক টিপ টিপ বৃষ্টির দিনে পার্থর এই গানের লিঙ্কটি পাঠিয়ে এক বন্ধু ইনবক্সে আমাকে লিখল, ‘দোস্ত, রাইনাকে মনে পড়ছে।’

রাইনা এখানে ছদ্মনাম হলেও আমার ওই বন্ধুর জীবনে সে ছিল বাস্তব। তাদের তিন বছরের প্রেম পরিণতি পায়নি।

এমনভাবে বর্ষাকালের এই নাগরিক টাপুরটুপুর হরেক কিছু মনে করায়। আমরা আমাদের মনের সেসব অনুভব কোথায় আর রাখি? সেঁটে রাখি ফেসবুকেই। সেদিন ওই ঘোর বৃষ্টির দিনে ফেসবুকে যখন এলোপাতাড়ি স্ক্রল করছিলাম, চোখ স্থির হলো অচেনা একজনের একটি ছবিতে—খোলা ছাদে কালো চুল ভিজিয়ে তুমুল ভিজছে এক তরুণী। সেই ছবির পাশে লেখা হুমায়ূন আহমেদের চরণ, ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়।’

একবার মনে হলো, মেয়েটি কি হুমায়ূন আহমেদের রূপা? ছবিটি কি পোস্ট করেছে কোনো হিমু? কালো চুলের মেয়েটির ছবি এবং হুমায়ূনের কথা মিলেমিশে এমন এক আবহ ঘটে গেল, মুহূর্তেই ভারী হয়ে উঠল মন।

স্বীকার করে নেওয়া ভালো, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বর্ষার দিনে মন ভারী হয়ে ওঠে আমার। আজকাল বৃষ্টি শুরু হওয়ামাত্র ইনবক্সে বর্ষিত হয় বউয়ের খুটখাট, ‘বৃষ্টি হচ্ছে, বাইরে তাকাও। বৃষ্টিতে ভিজবা?’

প্রশ্নটি সে করে বটে, কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, বৃষ্টির দিনে দুজন দুই অফিসে বসে ভেজা যায় না। ফলে ইনবক্সের ওই কথাবৃষ্টিই সই।

এমন দিনে এক কাপ চা হাতে তারে বলা যায়—ভালোবাসি
এমন দিনে এক কাপ চা হাতে তারে বলা যায়—ভালোবাসি

চিরকালই বৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে সৃষ্টি করে কথা। তাই হয়তো প্রেমে ব্যাকুল হয়ে আমরা স্পর্শ করতে চাই প্রেয়সীর হাত, সেই মানসীর উদ্দেশে কখনো কখনো কবিও হয়ে উঠি, কাব্য করে লিখে ফেলি দু–চার বাক্য। আর কবি যদি না–ও হতে পারি, অন্যের কবিতা আওড়াতে তো দোষ নেই:

‘মন মানে না বৃষ্টি হলো এত

সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে

আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল

স্পর্শ করি জলের অধিকারে।’

কী এমন হয়, যদি এই ভরা শ্রাবণে কোনো প্রেমিক উৎপলকুমার বসুর ‘নবধারা জলে’ নামের এ কবিতার কয়েকটি চরণ তার প্রেমিকার করকমলে পাঠায়; ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে বা ইনবক্সের নিভৃত অন্দরে।

বর্ষার বৃষ্টি মনে যেমন মনোরম অনুভব জাগায়, মনে হয় রাস্তায় নেমে ভিজি, তারপর ঘরে ফিরে ইলিশ–খিচুড়ির রসনায় তৃপ্ত করি মুখ; একইভাবে এ বর্ষার বেধড়ক বর্ষণের ‘সন্ত্রাস’ দুর্ভোগ আর বিঘ্নও কম ঘটায় না; প্রবল বৃষ্টির ফলে এখন যেমন দেশের অনেক জায়গা ভেসে যাচ্ছে, শুরু হয়েছে বন্যা। ঘরভাঙা মানুষের চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি একাকার হলে নাগরিক বর্ষার আকুল করা অনুভব নিশ্চয় আর জাগে না তাদের মনে। তবে বৃষ্টিসৃষ্ট বন্যায় মানুষই কিন্তু আবার মানুষের পাশে দাঁড়ায়; মানুষ হয়ে, মানুষের পাশে এসে, ভালোবেসে এখন যেমন দাঁড়িয়েছেন অনেকেই।

বর্ষা আদতে তাহলে প্রেমেরই বিষয়, মন কেমন করা ব্যাপার। তা না হলে মেঘ ঘন হলে আষাঢ়–শ্রাবণ মাসে আমাদের মন কেমন কেমন করে ওঠে কেন? তাই তো এই মুঠোফোন–ফেসবুক আচ্ছন্ন যুগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে বা অন্য কোনো শিক্ষায়তনে কোনো কোনো উচ্ছল তরুণ–তরুণীকে এখনো নির্ভাবনায় ভিজতে দেখা যায়। আর পরস্পরকে তারা এখনো বলে পুরোনো সেই কথাটি, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়।’ এরপরই গুনগুনিয়ে ঝুমবৃষ্টির মধ্যে তারা হয়তোবা গেয়ে ওঠে এই সময়ের শিল্পী মিনারের গান:

‘তুমি আমায় ডেকেছিলে

এক মেঘে ঢাকা দিনে

কেন আমি দিইনি সাড়া?

আমার চোখে আকাশ দেখে

তুমি বলেছিলে কিছু

বুঝিনি কেন সেই ইশারা...।’