শিশুর হেপাটাইটিস

‘হেপাটি’ হচ্ছে লিভার বা যকৃতের লাতিন প্রতিশব্দ।

যকৃতে কোনো কারণে প্রদাহ হলে তাকে ‘হেপাটাইটিস’ বলা হয়। বিভিন্ন কারণে তা হতে পারে। বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পিত্তনালি পথের ত্রুটি, জন্মগত কিছু রোগে লিভারের প্রদাহ হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জীবাণুঘটিত সংক্রমণ। এই সংক্রমণ যেমন ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া দ্বারা হয়ে থাকে, তেমনি হয়ে থাকে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে। এই ভাইরাসগুলোকে ‘হেপাটোট্রপিক ভাইরাস’ বলা হয়। ভাইরাসগুলো পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত—যথা এ, বি, সি, ডি, ই।

কীভাবে হেপাটাইটিস হয়

● হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাস দূষিত খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে ও অসুখ উৎপন্ন করে

● হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত রোগীর রক্ত (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) রক্তজাত ওষুধ, অপরিশোধিত সিরিঞ্জ, সুচ, রোগীর ব্যবহৃত ক্ষুর, রেজর, ব্লেড, ব্রাশ ইত্যাদির মাধ্যমে শিশু আক্রান্ত হতে পারে

● গর্ভবতী মায়ের শরীরে যদি বি ভাইরাস থাকে, তবে গর্ভস্থ সন্তান সে ক্ষেত্রে সংক্রমিত হতে পারে

● হেপাটাইটিস ডি সর্বদাই বি ভাইরাসের সহযোগী হয়ে আসে।

উপসর্গ ও লক্ষণ

জন্ডিসে চোখ, ত্বক হলুদ বর্ণ ধারণ করে। শরীরে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিসের উপসর্গ দেখা দেয়। 

● চুলকানি

● গাঢ় বাদামি বা কমলা রঙের মূত্র

● অন্যান্য পেটব্যথা (বিশেষত পেটের ডান পাশের ওপরের অংশে), মেটে রঙের মল, বমি বমি ভাব

● যকৃৎ স্ফীতি, ক্লান্ত, অবসাদ, কনফিউশন, বেশি ঘুম ঘুম ভাব

● হেপাটাইটিস বি–এর ক্ষেত্রে বাড়তি কিছু লক্ষণ যেমন গাঁটে ব্যথা, ত্বক চাকা চাকা হয়ে ফুলে ওঠা এসব দেখা যায়। 

● হেপাটাইটিস বি, সি বা ডি দিয়ে আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু কখনো কখনো ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায় এবং পরে সক্রিয় হয়ে রোগবিস্তার ঘটায়। একে বলা হয় ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস এবং তার পরিণামে লিভার ক্যানসার, সিরোসিস হয়ে থাকে। বিশেষত শিশুজীবনের প্রথম বছরে বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এই ঝুঁকি বেশি। খুব ছোট শিশু হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হলে জন্ডিস না–ও থাকতে পারে; বরং বুকের দুধ চুষে না খাওয়া, বমি, অত্যধিক অসুস্থতা—এসব অনির্দিষ্ট লক্ষণ থাকতে পারে।

পরীক্ষা–নিরীক্ষা 

● লিভার প্রোফাইল-লিভার এনজাইম ও বিলিরুন

● সিবিসি 

● হেপাটাইটিস প্যানেল 

● কোয়াগুলেশন প্রোফাইল 

● অ্যামোনিয়া 

● লিভারের আলট্রাসাউন্ড, সিটি, এমআরআই, নিউক্লিয়ার স্ক্যান

● পিত্তথলির হিডা স্ক্যান * ইআরসিপি 

● লিভার বায়োপসি-ল্যাপারোস্কোপি

● হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই নির্ণয়ের পরীক্ষা

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওপরের পরীক্ষাগুলোর কয়েকটি করে রোগ নির্ণয় করতে হবে।

চিকিৎসা কী

কারণ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনা করা হয়। চুলকানির জন্য মুখে খাওয়ানোর ওষুধ, ভিটামিন বি ও ফলিক অ্যাসিড দেওয়া যায়। একিউট লিভার ফেইলিওর চিকিৎসায় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট (প্রতিস্থাপন) ও ক্রনিক হেপাটাইটিসে নতুন কার্যকর চিকিৎসা রয়েছে।

যত্ন নেবেন যেভাবে

অ্যাসপিরিন–জাতীয় ওষুধ, এ ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার (ডিমের কুসুম, ডেইরি প্রোডাক্টস, মাছের তেল), হারবাল বা ভেষজ ওষুধ বর্জন করুন।

● চিকিৎসকের চিকিৎসাপত্র (প্রেসক্রিপশন) ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করাবেন না। 

● বেশি তরল খাবার ও পানি পান করাতে হবে। 

● পেটব্যথা থাকলে, ঝাল–মসলাদার ক্যাফেইনযুক্ত খাবার বাদ দিন।

● ধূমপানমুক্ত পরিবেশে রাখতে হবে শিশুকে। 

● এনেমা, ল্যাক্সেটিভ বেশি ব্যবহার না করা ভালো। 

● জন্ডিসের সময় বিশ্রাম দরকার।

● বমি হতে থাকলে ৫ মিনিট পরপর বয়সভেদে ১-২ চামচ করে খাওয়ার স্যালাইন (ওআরএস) খাওয়ানো দরকার। ফলের ঘন রস, জাঙ্ক ফুডস, দুগ্ধজাত খাবার, ঝাল ও মসলাদার খাবার না খাওয়ানো ভালো। লবণ কমাতে হবে, সঙ্গে প্রোটিনও।

স্কুল কার্যক্রম

হেপাটাইটিস এ–তে আক্রান্ত শিশুর জন্ডিস দেখা যাওয়ার ২ সপ্তাহ আগে থেকে ১ সপ্তাহ পর পর্যন্ত রোগজীবাণু ছড়াতে সক্ষম। তাই এ সময়কালে তাকে বিদ্যালয়ে না পাঠানো এবং কায়িক শ্রম থেকে বিরত রেখে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। 

রোগ প্রতিরোধের উপায় 

● শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পান ও কমপক্ষে দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ পান অব্যাহত রাখা। কোনো অবস্থাতেই শিশুকে ফিডার বা বোতলে পানি বা দুধ পান করাবেন না। এগুলোর মাধ্যমেই দূষিত খাওয়ার পানি শরীরে ঢোকে। 

● নিরাপদ পরিশ্রুত জল পান, আহার্য ও পানীয়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাড়িতে ভালো করে ফুটিয়ে পানি ব্যবহার করবেন।

● শৌচের পর, হেপাটাইটিস রোগীর সেবাকালে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে তবেই শিশুর খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা উচিত।

● শিশুকে সময়মতো টিকা দিন। হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধক টিকা এখন টিকাদান কর্মসূচির অংশ। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এবং বারবার রক্ত দিতে হয় এমন শিশুকে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধক টিকা অবশ্যই দিতে হবে। 

● শিশুকে রক্ত দেওয়া হলে সেই রক্ত নিরাপদ কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকুন।

● মায়ের দেহে বি ভাইরাস থাকলে গর্ভস্থ সন্তানের সংক্রমণ হতে পারে। তখন শিশু জন্মানোর ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রথম টিকা ও অন্য পাশের বাহুতে হেপাটাইটিস-ইম্যুনোগ্লোবুলিন নেওয়া উচিত। 

● শিশুর বয়স এক বছর পূর্ণ হলে ৬ থেকে ১২ মাসের বিরতিতে দুই ডোজ হেপাটাইটিস এ প্রতিরোধক টিকা দেওয়া যায়।

অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল