বাংলাদেশের জয় দেখতে চান 'বিশ্ব ভ্রমণকন্যা' এলিজা

কয়েক দিন ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখছেন ‘বিশ্ব ভ্রমণকণ্যা’ এলিজা বিনতে এলাহী। ছবি: সংগৃহীত
কয়েক দিন ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখছেন ‘বিশ্ব ভ্রমণকণ্যা’ এলিজা বিনতে এলাহী। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আছে বলেই ‘কক্সবাজার’কে চেনেন-জানেন অনেকে। কিন্তু কক্সবাজারের প্রাচীন নাম যে একটি হলুদ ফুলের নামে ছিল, কিংবা বাংলাদেশের একমাত্র মাটির গুহা যে টেকনাফে গহিন অরণ্যে পড়ে আছে, তা জানা আছে কয় জনের?

রামুর আছে পাঁচ হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। রামুতে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ১ হাজার ৪০০ বছর বয়সী চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং-এর হাতে রোপণ করা বিশাল বটবৃক্ষ। হিরাম কক্সের কক্সবাজার বা গোটা পার্বত্য অঞ্চলকে শাসন করেছে যুগে যুগে ত্রিপুরা রাজা, আরাকান রাজা, মগ, পর্তুগিজ, মুসলিম শাসক, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা। তাদের নানা স্মৃতি পড়ে আছে পাহাড়-জঙ্গলে। এসব ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর কী হাল, তার খোঁজ কি আমরা রাখি?

কয়েক দিন ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখছেন ইতিহাস-ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করে চলেছেন একজন ‘বিশ্ব ভ্রমণকণ্যা’ এলিজা বিনতে এলাহী। ‘প্রত্নতত্ত্ব গবেষক’ এই নারী ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেন হেরিটেজ ট্যুর। রাজধানী ঢাকা ছিল তাঁর প্রথম জেলা। এরপর ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, দিনাজপুরসহ ৫৯ জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করে গত শনিবার তিনি এসেছেন ৬০তম জেলা কক্সবাজারে।

এর আগে এলিজা বিনতে এলাহী ভ্রমণ করেন এশিয়া ও ইউরোপের ৪৭টি দেশ। সংগ্রহ করেন সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের নানা তথ্যউপাত্ত। এশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ইতিমধ্যে তাঁর দুটি প্রকাশনা রয়েছে। এর একটি ‘এলিজাস ট্রাভেল ডায়েরি’ আরেকটি ‘এলিজাস ট্রাভেল ডায়েরি-২’।

‘প্রত্নতত্ত্ব গবেষক’ এলিজা বিনতে এলাহী ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেন হেরিটেজ ট্যুর। ছবি: সংগৃহীত
‘প্রত্নতত্ত্ব গবেষক’ এলিজা বিনতে এলাহী ২০১৬ সাল থেকে শুরু করেন হেরিটেজ ট্যুর। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ভ্রমণকন্যা এলিজা ঘুরেছেন কক্সবাজারে। থাইল্যান্ডখ্যাত রামুর বৌদ্ধ পল্লি, কক্সবাজার শহরের রাখাইন ঐতিহ্য, প্রাচীন বৌদ্ধবিহার, পাহাড়চূড়ার বৌদ্ধ প্যাগোড়া, বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়ক, টেকনাফের কুদুমগুহা, মাথিনকূপ, মিয়ানমার সীমান্তে নাফদের জালিয়ারদিয়া, সাগরদ্বীপ মহেশখালীর মৈনাক পর্বতের ঐতিহাসিক আদিনাথ মন্দির, সেখানকার রাখাইন পল্লি, বৌদ্ধ বিহার ঘুরে ঘুরে দেখেন। এগুলো তাঁকে নাড়া দিলেও এসবের অব্যবস্থাপনায় তিনি হতাশও।

গত সোমবার রাতে শহরের মারমেইড ক্যাফেতে কথা হয় এলিজা বিনতে এলাহীর সঙ্গে। ক্যাফের সামনে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। উত্তাল সাগরের গর্জনও বারে বারে থামিয়ে দিচ্ছিল এলিজার বজ্রকন্ঠের কথামালা। বাংলাদেশের জয় দেখতে চান তিনি। চান হেরিটেজ ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিতে। বাংলাদেশের ঐতিহ্য তিনি ছড়াতে চান বিশ্বব্যাপী। কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর দাবি জাতীয়ভাবে একটি ‘হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে’ ঘোষণার।

বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার সহকারী অধ্যাপক এলিজা বিনতে এলাহী।

এলিজা বিনতে এলাহী ভ্রমণ করেন এশিয়া ও ইউরোপের ৪৭টি দেশ। ছবি: সংগৃহীত
এলিজা বিনতে এলাহী ভ্রমণ করেন এশিয়া ও ইউরোপের ৪৭টি দেশ। ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষাছুটিতে থাকা নেদারল্যান্ডসের হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সে অধ্যাপনারত এই বিশ্বপর্যটকের গবেষণার বিষয়ও ‘বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে হেরিটেজ ট্যুরিজমের গুরুত্ব’।

উপার্জিত অর্থে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ এবং এগুলো দেশ–বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন এলিজা বিনতে এলাহী। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে গিয়ে গ্রিক ও ইজিপ্সিয়ান সভ্যতা ও স্থাপনা সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। তা থেকেই এলিজার আগ্রহ তৈরি হয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো কীভাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা যায়, তা তার উচ্চতর পড়াশোনার বিষয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন একটি প্রকল্প ‘কোয়েষ্ট’ (অ্যা হেরিটেজ জার্নি ফর ডেভেলপমেন্ট)। এলিজার উদ্দেশ্য বাংলাদেশে হেরিটেজ ট্যুরিজম বা প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটনের গুরুত্বকে তুলে ধরা। সেই লক্ষ্যে ভ্রমণপিপাসু এলিজা দেশের প্রাচীনতম ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর তথ্য, ভিডিও চিত্র ও স্থিরচিত্র সংগ্রহ করছেন। প্রতি জেলায় খুঁজে পেয়েছেন বিশ্ব মানের স্থাপনা। কক্সবাজারও এর ব্যতিক্রম নয়।

এলিজা বিনতে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার ভ্রমণের আগে অল্প বিস্তর যেটুকু পড়াশোনা করে এসেছিলাম তাতে আমি হেরিটেজ ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা এখানে দেখেছি। পালংকিতে আমার পা পড়েছিল প্রথম ১৯৯২ সালে। অনেকেই হয়তো পরিচিত কক্সবাজারের এই প্রাচীন নামের সঙ্গে। প্যানোয়া নামেও ডাকা হতো কক্সবাজারকে। প্যানোয়া শব্দের অর্থ হলুদ ফুল। হলুদ ফুলটি দেখতে কী রকম কে জানে, কক্সবাজারের পাহাড়–জঙ্গল ঘুরেও খুঁজে পেলাম না সেই হলুদ প্যানোয়া।