মাংস সংরক্ষণ করবেন যেভাবে

মাংস একটি প্রথম শ্রেণির ও উচ্চমানসম্পন্ন আমিষজাতীয় খাবার, যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং জিংক, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম, ফসফরাস প্রভৃতির মতো মিনারেল আছে। যুগ যুগ ধরে মাংস খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু রাসায়নিক ও এনজাইমেটিক গঠনগত কারণে বাইরের আর্দ্রতা, আলো, তাপ, জীবাণু, অক্সিজেন প্রভৃতির প্রভাবে পচনে সহায়তাকারী ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, মোল্ডের মতো মাইক্রো অর্গানিজমের সংক্রমণে মাংস খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যবাহিত রোগ তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

সামনে কোরবানি ঈদ। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে প্রচুর কাঁচা মাংস থাকবে। তাই প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা, যাতে মাংস তাজা, স্বাস্থ্যকর ও ব্যাকটেরিয়ামুক্ত অবস্থায় খাওয়ার উপযোগী থাকে।

মাংস সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো-
• মাংসকে জীবাণুমুক্ত রাখা
• মাংসের স্বাদ ও গুণগত মান যতটা সম্ভব অক্ষুণ্ন রাখা
• মাংসের পচন রোধ করা
• মাংস দ্বারা খাদ্যবাহিত রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক ক্ষতি কমানো ।

মানুষ সেই প্রাচীনকাল থেকে দেশ-বিদেশে, ঘরে ও বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করার কৌশল ব্যবহার করে আসছে, যা এখন আরও উন্নত, সহজ ও যুগোপযোগী হয়েছে। প্রথমেই আসি ঘরোয়া কী কী উপাদান দিয়ে মাংস সংরক্ষণ করা যায়। আদার গুঁড়া, মিট এনহ্যান্সার, সয়া প্রোটিন পাউডার, ভিনেগার, কিউরিং সল্ট, ভেজিটেবল প্রোটিন, পাপরিকা পাউডার, সেলারি পাউডার এবং আলু দিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা যায়।

মাংস সংরক্ষণ করার অনেক পদ্ধতির মধ্যে কয়েকটা পদ্ধতি এখানে উল্লেখ করা হলো:

১. ফ্রিজিং
সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ডিপ ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণ করা। আমরা জানি, মাংসের ৫০-৭৫ ভাগ পানি। এই পানি থেকেই পচনশীল জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার নিচে ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণ করা উচিত এবং -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ওই পানির শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগই ক্রিস্টাল হয়ে পচন রোধ করে।

তবে ফ্রিজে মাংস রাখার আগে দুটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি—
ক. মাংস কাটার ধরন বা পদ্ধতি: সঠিকভাবে মাংস সংরক্ষণ করতে মাংস কাটতে হবে স্লাইস করে। অর্থাৎ পাতলা করে। মোটা ছোট ছোট টুকরা করে নয়। একেবারে অনেক মাংস একসঙ্গে না রেখে ছোট ছোট প্যাকেটে মাংস রাখা ভালো।
খ. মাংসে কতটা চর্বি আছে: আদর্শ পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণের জন্য মাংস থেকে চর্বি সরিয়ে ফেলতে হবে। অর্থাৎ, চর্বি ছাড়া মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে।

মাংস এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণের সময়ে প্লাস্টিক ব্যাগ/বক্স ব্যবহার না করে ভ্যাকিউম-সিল্ড ব্যাগ ব্যবহার করা স্বাস্থ্যসম্মত। মাংসের পুষ্টিমান ও স্বাদ ভালো রাখতে চাইলে গরুর মাংস ৮-১২ মাস এবং যেকোনো ধরনের মুরগির মাংস ৩-৬ মাসের বেশি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা উচিত নয়।

২। ড্রাইং পদ্ধতি
পুরোনো এই পদ্ধতিতে মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে ৭০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নিতে হয়; যা সবচেয়ে কম খরচে করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাংসের চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা করে কেটে ভ্যাকিউম-সিল্ড করে ফ্রিজে ১ বছর পর্যন্ত রাখা যায়।

৩। স্মোকিং
এটিও একটি পুরোনো পদ্ধতি, যেখানে হট স্মোকিং অর্থাৎ ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়ানো হয় এবং কোল্ড স্মোকিং পদ্ধতিতে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ধরে স্মোকিং আগুনে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়, যাতে তাপের ধোঁয়ায় মাংসের মাইক্রোবসগুলো নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে অবশ্য এই পদ্ধতির জন্য কিছু তরল স্মোক প্রিপারেশন পাওয়া যাচ্ছে, যা সাধারণত মাংস ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকেন।

৪। সল্টিং বা লবণ পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে খাওয়ার লবণ, কিউরিং লবণ, মসলা এবং ব্রাউন চিনি অথবা খাবার লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস মেখে ২৪ ঘণ্টা রেখে ফ্রিজে ১ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতি টিএফডিএ অনুমোদিত।
এই পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি ফ্রেশ এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। মাংসের অক্সিডেটিভ ও মাইক্রোবিয়াল পচন প্রতিরোধ এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো হয়।

৫। ক্যানিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিকে থার্মাল স্টেরিলাইজেশন বলে। যেখানে প্রথমে মাংস প্রায় ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ড্রাই করে ঠান্ডা করা হয়। কাচের জার বা বয়ামের মুখ আটকে তাতে এই মাংস প্রায় এক বছর রাখা যায়। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করতে গেলে কয়েকটি বিষয় খুব খেয়াল রাখতে হয়—প্রথমে মাংস কাটা, রান্নার আগে সিমিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঠান্ডা করা ইত্যাদি।

এ ছাড়া নতুন আরেকটি পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা যায়, যা আরও বেশি নির্ভরযোগ্য। এই পদ্ধতিতে মাংসের সঙ্গে আয়োনাইজড রেডিয়েশন, অর্থাৎ কোবাল্ট‌, গামা রেডিয়েশন, ইউ-ভি রেডিয়েশন ইত্যাদির মতো রেডিয়েন্ট এনার্জি ব্যবহার করা হয়, যাকে কোল্ড স্টেরিলাইজেশন বলা হয়। এই পদ্ধতিতে অধিকাংশ মাইক্রো অর্গানিজম মেরে ফেলা হয়। ফলে মাংস স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে।

তবে মাংস সংরক্ষণের আগে প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে মাংস কাটা, ধোয়া এবং সঠিক পাত্র ব্যবহার করা।

লেখক: শামছুন্নাহার নাহিদ, প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পুষ্টি বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল।