অতঃপর লেডি গোডিভা ঘোড়ায় চড়লেন

কভেন্ট্রি শহরে লেডি গোডিভার ভাস্কর্য। ছবি: লেখক
কভেন্ট্রি শহরে লেডি গোডিভার ভাস্কর্য। ছবি: লেখক

লেডি গোডিভা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি শচীন ভৌমিকের লেখা থেকে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। বইয়ের নাম ফর অ্যাডাল্টস অনলি। প্রবন্ধের নাম ‘স্ট্রিকিং’। তখন থেকেই এই মহীয়সী নারী সম্পর্কে আমার বিস্তর আগ্রহ। সে জন্য একসময় ইংল্যান্ডের ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম, তেমন কিছু পাইনি।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বদৌলতে এবার গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। আগে থেকেই পণ করেছিলাম কভেন্ট্রিতে যাব, লেডি গোডিভার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

গত ৯ জুন কেমব্রিজ থেকে যাত্রা শুরু করে প্রথমে গেলাম অক্সফোর্ড। সেখান থেকে স্ট্রাটফোর্ডে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের বাড়ি হয়ে কভেন্ট্রিতে। আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস এবং সহকর্মী মোর্শেদ নোমান। আমাদের পথপ্রদর্শক আমার ভাগনে মামুনুর রশীদ ও সাংবাদিক শোয়েব কবির। ভাগনের কাজ ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করা হলেও ইতিহাস বিষয়ে তাঁর বিস্তর আগ্রহ।

কভেন্ট্রি শহরের সিটি সেন্টারে যখন পৌঁছাই তখন বিকেল। দীর্ঘকেশী গোডিভার ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্যটি ৭০ বছর ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। গিয়ে দেখি সেখানে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। উৎসব ও গোডিভার ভাস্কর্যকে ঘিরে সেখানে দেখা গেল অগণিত স্থানীয় লোকজন ও পর্যটকের ভিড়। প্রতিবছর জুন মাসে কভেন্ট্রিতে তিন দিনের এক উৎসব হয়ে থাকে। এতে ব্রিটেনের নামীদামি শিল্পী ও কবি–সাহিত্যিকেরা অংশ নিয়ে থাকেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে এবারের উৎসব পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। উৎসব হয়েছে ৫ থেকে ৭ জুলাই।

বর্তমানে কভেন্ট্রির অবস্থান ওয়েস্ট মিডল্যান্ডে, মধ্যযুগে যা ছিল মার্সিয়ার অধীন। শহরটি স্ট্রাটফোর্ড থেকে ১৮২ কিলোমিটার এবং শিল্পনগরী বার্মিংহাম থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরটি জার্মান বিমানবাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছিল।

গোডিভানামা

এবার আসি গোডিভার কথায়। একাদশ শতকে এই কভেন্ট্রির জমিদার ছিলেন লিওফ্রিক। গোডিভা তাঁর স্ত্রী। দুজনই ছিলেন অ্যাংলো-সেক্সন গোত্রের। তখন পুরো ইংল্যান্ডেও ছিল স্যাক্সনদের রাজত্ব। লিওফ্রিক ও গোডিভা—দুজনই ছিলেন অভিজাত পরিবারের এবং ধর্মপ্রাণ। তার মধ্যে গোডিভা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী ও বিদুষী। স্থানীয় মানুষ এখনো মনে করে, গোডিভা তাদের এলাকায় জন্ম নিয়েছিলেন ঈশ্বরের কৃপায়।

লেডি গোডিভা ঘড়ি। ছবি: সংগৃহীত
লেডি গোডিভা ঘড়ি। ছবি: সংগৃহীত

লিওফ্রিক যখন কভেন্ট্রির লর্ড হিসেবে অভিষিক্ত হন, তখনো সেটি অখ্যাত নগরী। ১০৪৩ সালের দিকে তাঁরা কভেন্ট্রিতে একটি আশ্রম গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে শহরের নানান উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। দুজনই সাধারণ মানুষের মধ্যে ও গির্জায় দান করতেন উদার হস্তে। এসব কথা স্থানীয়দের মধ্যে উপাখ্যান ও উপকথার মতো ছড়িয়ে আছে।

উন্নয়নকাজ করতে গেলে টাকার প্রয়োজন হয়। একসময় উন্নয়নমূলক কাজের জন্যই লিওফ্রিক প্রজাদের ওপর কর আরোপ করেন। কিন্তু প্রজারা ছিল গরিব। যে কারণে গোডিভা কর প্রত্যাহারের জন্য লিওফ্রিককে অনুরোধ করেন। কিন্তু লিওফ্রিক স্ত্রীর অনুরোধ রাখেননি। তাঁর যুক্তি ছিল—সরকারি কোষাগারে অর্থের সংকট। যে টাকা আছে তা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া এবং রাজ্যের উন্নয়নকাজ করা সম্ভব নয়। তাই কর আরোপ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

লেডি গোডিভা তা মানতে রাজি নন। তিনি বিষয়টি নিয়ে লিওফ্রিককে অবিরাম চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে লিওফ্রিক স্ত্রীর আচরণে ক্ষুব্ধ হন। এ অবস্থায় তিনি কূটকৌশলের আশ্রয় নেন। লিওফ্রিক স্ত্রীকে শর্ত দেন, তিনি যদি নগ্ন শরীরে ঘোড়ায় চড়ে কভেন্ট্রি শহর প্রদক্ষিণ করতে পারেন, তবেই কর মওকুফ করে দেওয়া হবে। লিওফ্রিক ভেবেছিলেন, গোডিভা কঠিন এই শর্তে রাজি হবেন না এবং দাবি থেকে সরে দাঁড়াবেন।

কিন্তু ঘটল উল্টো, যা লিওফ্রিকের কল্পনাতেও ছিল না। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গোডিভা শুরুতে স্বামীর নিষ্ঠুর প্রস্তাবে ভালোমন্দ কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে ও কর্তব্যকাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। স্বামীর প্রস্তাব অনুযায়ী গোডিভা নগ্ন শরীরে ঘোড়ায় চড়ে কভেন্ট্রি শহর ঘুরে বেড়ানোর জন্য মনস্থির করলেন এবং ঘোষণা দিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে লিওফ্রিক স্ত্রীকে নিরস্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত লিওফ্রিক বিনা শর্তে স্ত্রীর দাবি মেনে নেওয়ারও ঘোষণা দেন। কিন্তু কঠিন মনোবলের অধিকারী গোডিভা স্বামীর অনুরোধ রাখলেন না। অগত্যা লিওফ্রিক বাধ্য হয়ে নির্দেশ দিলেন, গোডিভা যখন ঘোড়ায় চড়ে নগরী প্রদক্ষিণ করবেন, তখন কোনো নাগরিক রাস্তায় বের হতে পারবেন না এবং নগরীর প্রতিটি ঘরের দরজা ও জানালা বন্ধ রাখতে হবে।

অতঃপর স্বামীর দেওয়া শর্ত পূরণ এবং এর মাধ্যমে প্রজাদের মাথা থেকে করের বোঝা নামানোর জন্য গোডিভা নগ্ন শরীরে ঘোড়ায় চেপে বসেন। ঘোড়ায় উপবিষ্ট গোডিভার শরীরের সামনের অংশ ছিল তাঁর দীর্ঘ চুলে ঢাকা। এ অবস্থায় তিনি কভেন্ট্রি শহর ঘুরে বেড়ান। এ ঘটনার সময় শহরের বাসিন্দারা গোডিভার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অংশ হিসেবে ঘরের দরজা–জানালা বন্ধ রাখেন।

কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন টম নামের এক দরজি। তিনি গোপনে জানালার ফাঁক দিয়ে গোডিভার নগ্ন শরীর প্রত্যক্ষ করেন। টমের এই অপকর্ম থেকে পরে ‘পিপিং টম’ শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ গোপনে উঁকি দিয়ে অন্যের গোপন কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করা।

গোডিভার এই কর্ম প্রজাদের কর থেকে মুক্তি দিয়েছিল কি না, সেই সম্পর্কে ইতিহাস বা স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে তেমন জানা যায় না। তবে ঘটনাটি গোডিভাকে সম্মানের আকাশচুম্বী উচ্চতায় তুলে দিয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে বহু কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীকে তাঁদের চর্চার খোরাকের জোগান দিয়েছে।

গোডিভার ভাস্কর্য

স্কটিশ ভাস্কর স্যার উইলিয়াম রেইড ডিক ১৯৪৯ সালে কভেন্ট্রি শহরের কেন্দ্রে নির্মাণ করেন গোডিভার ভাস্কর্য। ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল আকৃতির এই শিল্পে দেখা যায়, নগ্ন গোডিভা ঘোড়ার ওপর বসে আছেন। তাঁর দীর্ঘ কেশরাশি ঢেকে দিয়েছে শরীরের সামনের অংশ। ব্রোঞ্জের তৈরি গোডিভা ও ঘোড়াকে ধারণ করেছে পাথরের তৈরি বেদি। সেই বেদিতে খোদাই করা লেখা
আছে গোডিভাকে নিয়ে লেখা আলফ্রেড টেনিসনের বিখ্যাত কবিতা—গোডিভা।

গোডিভার স্মৃতিস্তম্ভকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত তথ্যমতে, টেনিসন ‘গোডিভা’ কবিতাটি লিখেছিলেন ১৮৪০ সালে। তবে এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪২ সালে। বেদিতে খোদাই করা কবিতার লাইন—দেন শি রোড ব্যাক ক্লোথড অন উইথ/ চ্যাসটিটি শি টুক দ্য ট্যাক্স অ্যাওয়ে অ্যান্ড/ বিল্ট হারসেলফ অ্যান এভারলাস্টিং নেম। যার অর্থ সৎ কর্মের মাধ্যমে কর রহিত করে তিনি তাঁর নামকে অন্য রকম এক উচ্চতায় নিয়ে যান।

ব্রিটিশ িশল্পী এডমন্ড লেইটনের চিত্রকর্মে গোডিভার িসদ্ধান্ত নেওয়ার সেই মুহূর্ত
ব্রিটিশ িশল্পী এডমন্ড লেইটনের চিত্রকর্মে গোডিভার িসদ্ধান্ত নেওয়ার সেই মুহূর্ত

ব্রিটিশ চিত্রকর জন কলিয়ার গোডিভাকে নিয়ে ১৮৯৭ সালে যে চিত্রকর্মটি তৈরি করেছিলেন, সেটিও এখন জগদ্বিখ্যাত। ছবিটি কভেন্ট্রির হার্বার্ট আর্ট গ্যালারি অ্যান্ড মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, গোডিভার গল্পটি নিরেট গল্পই, সত্য নয়। যা কিছু আছে তার সবই জনশ্রুতিনির্ভর। এই মতের অন্যতম সমর্থক রাজা অষ্টম হেনরির কর্মকাণ্ডের ধারাবিবরণী লেখক রিচার্ড গ্র্যাফটন। তিনি ১৫৬২-৬৩ সালে কভেন্ট্রি থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি একজন চিত্রশিল্পীও ছিলেন।

অবশ্য অক্সফোর্ডের অভিধানে লিওফ্রিক ও গোডিভার ঘটনার উল্লেখ আছে। সেখানে দুজনকে কিংবদন্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্ভবত লিওফ্রিক ও গোডিভার বিয়ে হয়েছিল ১০১০ সালের আগে। লিওফ্রিক মারা যান ১০৫৭ সালে। কলিনসের অভিধানে বলা হয়েছে, লেডি গোডিভা ১০৮০ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফিতে বলা আছে, লিওফ্রিককে সমাহিত করা হয়েছে ওরচেস্টারশায়ারের ইভশ্যাম শহরের হলি ট্রিনিটি গির্জায়। গোডিভাকে কেন্দ্র করে কভেন্ট্রি সিটি সেন্টারে গড়ে ওঠা সংগ্রহশালার তথ্য অনুযায়ী, স্বামীর মৃত্যুর পর গোডিভা নরম্যান কনকোয়েস্টে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিস্তর বিত্ত ও জমির মালিক ছিলেন।

আধুনিক ইতিহাস লেখকেরা বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। তা সত্ত্বেও বেশ আগ্রহ নিয়ে যোগাযোগ করেছিলাম ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের দুই অধ্যাপকের সঙ্গে। অধ্যাপক রেবেকা আর্ল বলেন, উৎসবের মাধ্যমে লেডি গোডিভাকে স্মরণ করে মানুষ ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পায়, নারীকে সম্মান করার প্রেরণা খুঁজে পায়। সুতরাং এমন একজন নারীর ইতিহাস সত্যি কি মিথ্যা, সেই বিতর্ক অর্থহীন।

অধ্যাপক বিট কিউমিন বলেন, গোডিভার বিষয়টি প্রথম লেখালেখিতে উঠে আসে ত্রয়োদশ শতকে। কিন্তু সেই সূত্রগুলো খুব এটা শক্তিশালী নয়। যে কারণে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা চরিত্রটি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী হননি। তা সত্ত্বেও আমরা যথেষ্ট উৎসাহ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গোডিভাকে স্মরণ করি।

মজার বিষয় হলো, কভেন্ট্রির বাইরে খুব কম মানুষই লেডি গোডিভা সম্পর্কে জানেন। তবে গোডিভার নামে নামকরণ করা চকলেট বা প্রসাধনসামগ্রীর সঙ্গে সবারই পরিচয় আছে। অর্থের মানদণ্ডে এসব সামগ্রী যথেষ্ট দামি হওয়া সত্ত্বেও দেদার বিক্রি হয়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে।

যেভাবে যাবেন

লন্ডন গেলে বেড়িয়ে আসতে পারেন কভেন্ট্রি থেকে। ট্রেনে লন্ডন থেকে কভেন্ট্রির দূরত্ব ১৭৭ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা ২৪ মিনিট। বাসে যেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। দূরত্ব ১৩৮ কিলোমিটার। দুটি পথেই নিয়মিত বিরতিতে সারা দিনই ট্রেন ও বাস চলাচল করে। তবে কেউ যদি গাড়িতে যেতে চান, সে ক্ষেত্রে পথিমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার সুযোগ থাকবে।