মাংসের কোন অংশে কী রান্না

কল্পনা রহমান: রন্ধনবিদ ও সেরা রাঁধুনী প্রতিযোগিতার বিচারক
কল্পনা রহমান: রন্ধনবিদ ও সেরা রাঁধুনী প্রতিযোগিতার বিচারক

পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির মাংস সবার বাড়িতে থাকেই। হয় হরেক রকম রান্নাবান্না। গরুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব অংশের মাংসই ঘরে আসে। তবে সেই মাংসের কোন অংশের কী নাম আর কতভাবেই সেগুলো কাটা যায় বা রাঁধা যায়, তা অনেকের কাছেই অজানা। ধাপে ধাপে জেনে নেওয়া যাক সে বিষয়গুলো।

রানের মাংস: পেছনের রানের মাংস দিয়ে কাবাব ভালো হয়। কারণ, রানের মাংস কিমা করা যায় ভালো। তাই কিমাজাতীয় যত রেসিপি, তা সবই রানের মাংস দিয়ে করা হয়। রানের মাংস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের টিকিয়া, কাবাব, গ্রিল ইত্যাদি বানানো হয়।

সিনার মাংস: সিনার মাংস অনেকের খুব প্রিয়। এই অংশের মাংস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিরিয়ানি, কোরমা, রেজালা, সুস্বাদু চাপ ইত্যাদি খুবই ভালোভাবে বানানো হয়। এই অংশের মাংসে চর্বি ও কুড়মুড়ে হাড় থাকে।    তবে সাধারণ রান্নার মাংসের সঙ্গে মিলিয়ে রান্না করলে আরও মজার হয়ে ওঠে।

টেন্ডার লোয়িন: গরুর পিঠের অংশের মাংসকে বলে টেন্ডার লোয়িন। এই অংশ দিয়ে আমরা দেশি-বিদেশি সব ধরনের রান্নাই খুব তাড়াতাড়ি করতে পারি। যেমন বিফস্টেক, কোল্ডবিফ, রোস্ট, গ্রিল, সতে সিজলিং ইত্যাদি।

কলিজা: কলিজায় রয়েছে প্রচুর আয়রন। পাশাপাশি কোলেেস্টরলের পরিমাণও প্রচুর। তাই কলিজা কেটে হলুদ ও লবণ দিয়ে একটি বলক তুলে ছেঁকে নিতে হবে। এরপর কলিজা রান্নার উপযোগী হবে। এভাবে কলিজা অনেক দিন ফ্রিজে রাখাও যায়। কলিজা দিয়ে অনেক মজার মজার রেসিপি তৈরি করা যায়, যেমন কাচুরি মেথি কলিজা, সাতকরা দিয়ে কলিজা ভুনা, থাই স্টাইলে দই কলিজা, সসেজ কলিজা, গ্রিলড কলিজা, কলিজা ভর্তা, কলিজার শাশলিক, কলিজার শিঙাড়া ইত্যাদি। তা ছাড়া মাংসের সঙ্গে নিয়েও কলিজা রান্না করা যায়।

মগজ: মগজ আকারে ছোট। এটি উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত একটি খাবার। মগজ ফ্রিজে না রেখে দ্রুত রান্না করা ভালো। মগজ ভালোভাবে ধুয়ে ওপরের পর্দা অবশ্যই তুলে ফেলতে হবে। ভেতরে রক্তের যে শিরা থাকে, সেগুলোও ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মগজ ভুনা, ফ্রাই কাবাব, কাটলেট, সবজির সঙ্গে মিলিয়ে অথবা দই দিয়ে রান্না করা যায়। তবে মগজ বয়স্ক এবং অসুস্থ লোকদের না খাওয়া ভালো।

হাঁটু ও পা: এই অংশটি স্লো কুচিং পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। পায়ের অংশ দিয়ে স্যুপ, নেহারি এবং কিছু থাই রান্না, যা সকালের নাশতায় খুব প্রিয়। পায়ার সঙ্গে নান, পরোটা, রুমালি রুটি, চালের আটার রুটি, লুচি এমনকি লাল আটার রুটিও খুব মজা করে খাওয়া যায়।

জিহ্বা: জিহ্বা পরিষ্কার করা কিছুটা ঝামেলার। তবে গরম পানিতে সেদ্ধ করে ওপরের চামড়া খুব সহজেই পরিষ্কার করা যায়। এরপর ছোট ছোট টুকরা করে ভুনা বা কাবাব করা যায়। তবে জিহ্বার কোল্ড সালাদ স্যান্ডুইচ খুব প্রসিদ্ধ একটি খাবার।

লেজ: বিদেশে গরুর লেজ খুবই পছন্দের একটি খাবার উপাদান। ষাঁড়ের লেজ খুব মোটা হয়। তাই ষাঁড়ের লেজের রান্নাগুলো খুব সুস্বাদু ও মজাদার হয়।

আমরা সাধারণত তিন পদ্ধতিতে রান্না করে থাকি—স্লো কুকিং, থাই হিট আর মাঝারি আঁচে। স্লো কুকিং পদ্ধতিতে রান্না করলে মাংস খুব নরম হয়। কোরবানির সময় আত্মীয়স্বজনের বাসা থেকেও মাংস আসে। এই মাংস দিয়ে আমরা চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ মেজবানি মাংস বা সাধারণ মাংস রান্না করে ঝুরা করে ফ্রিজে রেখে অনেক দিন খেতে পারি।

রান্না করা মাংস থেকেও আমরা অনেক নতুন রেসিপি বানাতে পারি। যেমন—

  • ওই রান্না মাংসে কিছু টমেটো, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে বাগার দিলেই তৈরি হয়ে যাবে একটি নতুন রেসিপি।
  • রান্না করা মাংসে টমেটো সস আর মেথির ফোড়নে তৈরি হয়ে যাবে একটি নতুন রেসিপি, যা রুটি বা পরোটার সঙ্গে অতুলনীয়।
  • রান্না করা টাটকা মাংসের টুকরাগুলো কাঠিতে গেঁথে বাটারে ডুবিয়ে ডিপ ফ্রাই করে নিলেই তৈরি হবে লোভনীয় কাঠি কাবাব।
  • আবার কাঠিতে মাংসের সঙ্গে শশা, ক্যাপসিকাম, গাজর গেঁথে বাটারের সঙ্গে ভিন্ন স্বাদের শাশলিকও বানাতে পারি।
  • রান্না মাংসে কয়লার ধোঁয়া দিলেই স্মোকি স্বাদের গরুর রেসিপি তৈরি হয়ে যাবে।

যেভাবে মাংস সংরক্ষণ করবেন

গরু জবাই দেওয়ার পর অভিজ্ঞ কসাই দিয়ে নিজে সামনে থেকে কোন অংশের মাংস কীভাবে করতে হবে, বলে দেওয়া যায়। এতে পরবর্তীকালে সেই মাংস দিয়ে সহজেই প্রয়োজনীয় রান্না করা যাবে। গরুর মাংস বানানোর পর যখন মাংস ঘরে আসবে, তখন সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রিজে না রেখে ১–২ ঘণ্টা পর যখন মাংস একটু শুকিয়ে আসবে, তখন প্যাকেট করে ফ্রিজে রাখতে হবে। তবে এক প্যাকেটে ২–৩ কেজি মাংস রাখা ভালো। সর্বোচ্চ ৫ কেজির বেশি মাংস একসঙ্গে রাখা উচিত নয়। ছোট ছোট মাংসের প্যাকেট তাড়াতাড়ি বরফ হয়ে যায়। এতে মাংস ফ্রিজে নষ্ট হওয়ার ভয় কম।

একটি প্যাকেটের ওপর যখন আরও একটি প্যাকেট রাখা হবে, তখন একটি করে পাতলা কাঠ দিয়ে রাখলে মাংস ওঠাতে সুবিধা হবে। কলিজা স্টোর করার আগে অবশ্যই ভিনেগার ও হলুদ–লবণ পানিতে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে শুকিয়ে নিতে হবে।

মাংসের প্যাকেট ফ্রিজে রাখার ২–৩ ঘণ্টা পরপর কয়েকবার নেড়েচেড়ে দিতে হবে। এতে মাংসগুলো বের করতে সুবিধা হবে। মাংস ফ্রিজে রাখার পর ১৮ থেকে ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে সংরক্ষণ করতে হয়। তাহলে অনেক দিন মাংস ফ্রিজে ভালো থাকে। ফ্রিজে রাখা মাংসগুলোর প্যাকেটে কোন অংশের মাংস, সেটা লিখে রাখলে চট করে খুঁজে পেতে সুবিধা হবে। মাংস আমরা অল্প হলুদ মাখিয়ে তারে গেঁথে শুকিয়েও সংরক্ষণ করতে পারি। সংরক্ষণের জন্য অন্য মসলার সঙ্গে একটু বেশি করে তেল-চর্বি দিয়ে রান্না করেও মাংস অনেক দিন ঘরে রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে দিনে দুবার জ্বাল দিতে হবে।

কল্পনা রহমান: রন্ধনবিদ ও সেরা রাঁধুনী প্রতিযোগিতার বিচারক

কল্পনা রহমানের দেওয়া রেসিপি

হানি–চিলি সসে কাবাবি রেডমিট

উপকরণ: খাসির মাংস ১ কেজি, আদাবাটা ১ টেবিল চামচ, অয়েস্টার সস ১ টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, সয়াসস ১ টেবিল চামচ, মাস্টারজেস্ট ১ টেবিল চামচ, গোলমরিচের গুঁড়া সিকি চা–চামচ, বারবিকিউ সস ২ টেবিল চামচ, লবণ পরিমাণমতো, সরিষার তেল সিকি কাপ, টুথপিক প্রয়োজনমতো, বাটার ২৫ গ্রাম ও মধু ১ টেবিল চামচ।

আনারস সসের জন্য—আনারসের রস আধা কাপ, কর্নফ্লাওয়ার ২ টেবিল চামচ, চিনি সিকি কাপ, আনারস কিউব আধা কাপ, সিরকা ২ টেবিল চামচ ও লবণ আধা চা-চামচ।

প্রণালি: সসের সব উপকরণ একসঙ্গে জ্বাল দিলেই তৈরি হয়ে যাবে আনারস সস। খাসির মাংস কেটে ওপরের সব উপকরণ দিয়ে ম্যারিনেট করে ১ ঘণ্টা ঢেকে রাখতে হবে। এবার ২ কাপ পানি দিয়ে চুলায় বসাতে হবে। সেদ্ধ হয়ে যখন পানি শুকিয়ে যাবে, তখন মসলা থেকে মাংসের টুকরাগুলো তুলে ২ টেবিল চামচ মধু দিয়ে মাখিয়ে নিতে হবে। টুথপিকে গেঁথে ননস্টিক ফ্রাইপ্যানে সামান্য বাটার দিয়ে সোনালি করে ভেজে আনারসের সস দিয়ে পরিবেশন করতে হবে।