আহ! গরমে শান্তি

ভ্যাপসা গরমে পানিতে সাঁতার কাটলে প্রশান্তি আসবে সারা দিনের জন্যই। মডেল: মাহি ও মিথিলা, স্থান: লা মেরিডিয়ান, ঢাকা, ফটোশুট নির্দেশনা: বিপাশা রায়, ছবি: কবির হোসেন
ভ্যাপসা গরমে পানিতে সাঁতার কাটলে প্রশান্তি আসবে সারা দিনের জন্যই। মডেল: মাহি ও মিথিলা, স্থান: লা মেরিডিয়ান, ঢাকা, ফটোশুট নির্দেশনা: বিপাশা রায়, ছবি: কবির হোসেন
>মাঝেমধ্যে আকাশের মুখ গোমড়া হলেও গরমের তেজ কমেনি এখনো। মন চায় যেন সুইমিংপুল বা পুকুরের জলে ভিজি। ছোটখাটো কিছু বিষয় মেনে চললে এখন জীবনযাপনে পাওয়া যাবে স্বস্তি।

একদমে এ মাথা থেকে ও মাথা সাঁতরে চলে যাব। যদি এ মুহূর্তে কেউ সুইমিংপুলটা পিচঢালা রাস্তার ওপরে বিছিয়ে দেয়। ভ্যাপসা গরমের সময় দুই ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকলে এমন চিন্তাই ঘুরেফিরে আসে। ভাবনাতেই যেন শান্তি পায় মন।

দৃশ্যপট বদলে যাক। যদি একটু বৃষ্টি হতো। হাত বাড়িয়ে যদি পাওয়া যেত শীতল ছোঁয়া। কিন্তু বৃষ্টি শেষ হলেই যেন রোদ আর গরমের শাসন বেড়ে যায়। রোদ কিংবা বৃষ্টি—মুঠোফোনের অ্যাপে যেটাই দেখাক না কেন, চারপাশের আবহাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত। থাকবে আরও বেশ কিছুদিন। এর মধ্যেই খুঁজে নিতে হবে আরাম আর দুদণ্ড শান্তি!

‘সূর্যের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ড—ক্যালসিয়াম পুড়িতেছে, হাইড্রোজেন পুড়িতেছে, লোহা পুড়িতেছে, নিকেল পুড়িতেছে, কোবাল্ট পুড়িতেছে—জানা–অজানা শত শত রকমের গ্যাস ও ধাতু কোটি যোজন ব্যাসমুক্ত দীপ্ত ফার্নেসে একসঙ্গে পুড়িতেছে—তারই ধু-ধু আগুনের ঢেউ অসীম শূন্যের ঈথারের স্তর ভেদ করিয়া ফুলকিয়া বইহার ও লোধাইটোলার তৃণভূমিতে বিস্তীর্ণ অরণ্যে আসিয়া লাগিয়া প্রতি তৃণপত্রের শিরা–উপশিরার সব রসটুকু শুকাইয়া ঝামা করিয়া, দিগ্​দিগন্ত ঝল্​সাইয়া পুড়াইয়া শুরু করিয়াছে ধ্বংসের এক তাণ্ডব-লীলা। চাহিয়া দেখিলাম দূরে দূরে প্রান্তরের সর্ব্বত্র কম্পমান তাপ-তরঙ্গে ও তাহার ওধারে তাপজনিত একটি অস্পষ্ট কুয়াশা।’ গরমের সময়ে আমাদের মনের কথাটাই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গেছেন আরণ্যক উপন্যাসে।

আবহাওয়া আমাদের জীবনযাপন এমনই কাহিল করে রেখেছে। সারাক্ষণ গরমের চিন্তাটাই মাথায় ঘুরতে থাকে। সঙ্গে নিত্যনতুন যোগ হচ্ছে রোগবালাই। আবহাওয়ার ওপর তো আর হাত নেই কারও, তাই বদলে ফেলতে হবে নিত্যদিনের চলাফেরা। যাঁরা পড়ছেন তাঁরা হয়তো ভাবছেন লেখা যত সহজ, করা ততটা নয়। তবে চেষ্টা করতে দোষ কী?

হালকা রঙের পোশাক আরামের আমেজ এনে দেবে। ছবি: নকশা। সাজ: পারসোনা
হালকা রঙের পোশাক আরামের আমেজ এনে দেবে। ছবি: নকশা। সাজ: পারসোনা

সকাল শুরু হয়ে যাক গোসল দিয়ে। সময় থাকলে একটু বেশিক্ষণ, না থাকলে তাড়াহুড়োর মধ্যে কাকভেজাই সই। সকালের গরমটা চলে যাবে। সতেজ বোধ হবে মনেও। বাইরে বের হলেই মাথা গরম হয়ে উঠবে না। মাথা গরম থাকলে সেই অনুভূতি কিন্তু ছড়িয়ে পড়ে শরীরেও। দিন শেষে আরেকবার না হয় ঝরনার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

ইউরোপে বা আমেরিকায় গরমের জন্য অপেক্ষা করা হয় সারা বছর। আমাদের দেশে উল্টো। শীতকাল শ্রেষ্ঠ, অনুভূতি বলেন আর ফ্যাশনেবল পোশাক পরার কথাই বলেন। এককথায় তা জানিয়েও দিই আমরা। তবে শীতের সময়েও ইদানীং গরম থাকে। হাড়–কাঁপানো শীত শুধু বইয়ের পাতাতেই যেন সীমাবদ্ধ।

গরমের পোশাক নিয়ে পুরো দুনিয়াতেও চলছে বেশ জল্পনা–কল্পনা। তবে পাশ্চাত্যের গরম আর আমাদের গরমে কিছুটা পার্থক্য আছে। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে গরমের মধ্যেই হালকা ঠান্ডা আমেজ অনুভব করা যায়। পোশাকের নকশা আর কাপড়ে এ কারণেই পার্থক্য চলে আসে।

দেশের বাইরে খাটো প্যান্ট আর টপ এ সময়ের পোশাক। এ ছাড়া ঢিলে লম্বাটে পোশাক, হাঁটু পর্যন্ত পোশাক, জাম্পস্যুট ইত্যাদিও দেখা যায়। মোদ্দাকথা পায়ের অংশে খুব আঁটসাঁট কিছু না পরাই ভালো। ঘের দেওয়া লম্বা কাটের পোশাকে আরাম পাবেন প্রতিমুহূর্তেই।

শাড়ি পরলে ব্লাউজের কাট-ছাঁটে আরাম নিয়ে আসুন। এখন ব্লাউজ হিসেবে ক্রপ টপ কিংবা প্রজাপতির হাতা বেশ চলছে। হাতা কাটা তো আছেই। সুতি, লিনেনের পোশাকে আরাম আমাদের দেশের জন্য। হালকা রং বেছে নিন।

মার্কিন ফিকশন লেখক জেনি হানের মতে, সব ভালো, সব জাদুকরি ঘটনা জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যেই ঘটে। বাড়ি থেকে বেরোলে অবশ্য এ ধারণা উবে যায়। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় অভ্যস্ত জীবন রাস্তার গরমে হাঁপিয়ে যায়। পকেটে নিয়ে ঘোরা ছোট ব্যাটারিচালিত পাখা কিছুটা হলেও আরাম দেয় এ সময়। প্রাথমিকভাবে স্বস্তি দেবে রোদচশমাও। রোদের ঝাঁজ চোখে কম লাগলে মনও কিছুটা শান্ত থাকে। ছাতা তো আছেই। ওয়াইপস (ভেজানো টিস্যু পেপার) বা ছোট মিস্টের বোতল রাখতে পারেন ব্যাগে। মাঝেমধ্যে মুখে পানির পরশ মন্দ লাগবে না। অবশ্যই অবশ্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। এটা এখন বাধ্যতামূলক।

‘সূর্যের নিচে নেচে বেড়াই, চুলে বুনোফুল গুঁজে’ গরমকে উপভোগ করা উচিত মার্কিন কবি সুসান পলিস শ্যুটসের কথামতোই। তবে আমাদের দেশে এখন চুল বাঁধাই থাকুক, ঘাড় খোলা রেখে। সেই চুলে থাকুক এই সময়ের ফুল। কড়া রোদ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন নকশার হ্যাট ব্যবহার করতে পারেন। সমুদ্রসৈকতে এই হ্যাট মানিয়ে যায় যেকোনো পোশাকের সঙ্গেই। শহুরে জীবনে কি অস্বস্তি লাগবে? পাশ্চাত্য পোশাকের সঙ্গে কিন্তু সহজেই মানিয়ে যাবে।

ভ্যাপসা গরমের দিনগুলোতে ত্বকও হয়ে পড়ে শুষ্ক। আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা ত্বক আর্দ্র রাখার পরামর্শ দিলেন। ভেতর–বাইরে দুই জায়গাতেই। অর্থাৎ পানি বা শরবত পান করুন বেশি করে। পানি বেশি আছে এমন ফল বা সবজি রাখুন খাবারের তালিকায়। ত্বকে মানাসই ক্রিম বা লোশন লাগান প্রতিদিন অন্তত দুবার।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা; মানতেই হবে গরমে আরাম পেতে। প্রতিদিন ধোয়া ও ইস্ত্রি করা পোশাক পরুন। ব্যায়াম করুন। মন স্থির থাকবে। মেকআপ হালকা রাখুন। সারা দিনের ছুটোছুটিতে হালকা গয়না পরুন। রান্নাঘরের কাজের সময় কাটাকুটির কাজগুলো ফ্যানের নিচে করুন। ভাজাপোড়া যত কম খাবেন, শরীর তত আরাম পাবে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের একটি লাইন মনে পড়ে যায়, ‘...রোদ চড়া হয়ে আসে, শূন্য আকাশ বিশাল নগ্নতায় নীল হয়ে জ্বলেপুড়ে মরে।...’

যেখানে বিশাল আকাশই রেহাই পায় না, আমরা কোন ছার। তবে প্রতিদিন ছোট ছোট বিষয় মাথায় রাখলে আরাম পাবেন জীবনযাত্রায়। আরামদায়ক পোশাক পরুন। পানির বোতলটি হাতের নাগালে রাখুন। পায়ের জুতাজোড়া যেন আরামদায়ক হয়। এই তো...গরমেও খুঁজে নিন শান্তি।