বোঝাপড়া ভালো তো দাম্পত্যও ভালো

দাম্পত্যে বোঝাপড়া থাকলে মনোমালিন্য দূর হবে দ্রুতই। ছবি: কবির হোসেন
দাম্পত্যে বোঝাপড়া থাকলে মনোমালিন্য দূর হবে দ্রুতই। ছবি: কবির হোসেন

ত্রিশতম বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন করছেন মনোয়ার সাহেব। আমি পায়েসের বাটি থেকে এক চামচ পায়েস মুখে পুরে জানতে চাইলাম দীর্ঘ দাম্পত্যের রহস্য। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘পায়েস কেমন হয়েছে?’ সত্যি বলতে পায়েস খাচ্ছি নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারছি না। স্বাদ মোটেও ভালো নয়। তবু ভদ্রতাসূচক মাথা নেড়ে বললাম, বেশ ভালো হয়েছে।

মনোয়ার সাহেব হেসে বললেন, ‘ভালো যে হয়নি সেটা আমি জানি। শুরুতে তোমার মতো আমিও একদম খেতে পারতাম না। তবে এখন কিন্তু আমার একেবারে মন্দ লাগে না। ওই যে ত্রিশ বছরের অভ্যাস!’ বললাম, কথাটা অনেকটা বেলাশেষে সিনেমার মতো মনে হচ্ছে যে! ‘আসলে বেলা শেষেই তো আমরা সবকিছু বুঝতে পারি!’ উনি হেসে বললেন, ‘আরেকটা ব্যাপার অবশ্য আছে, ভদ্রমহিলা আমার জন্য খুব যত্ন নিয়ে আমার পছন্দের খাবারটি রান্না করে চলেছেন। এর–তার কাছ থেকে রেসিপি নিচ্ছেন, রান্নার বইপত্র ঘাঁটছেন। সত্যি বলতে চেষ্টার কমতি রাখেননি কিন্তু খাবারের স্বাদের কোনো উন্নতি হয়নি। তবে আমার উন্নতি হয়েছে। স্ত্রীর হাতের বানানো পায়েস দিন দিন পছন্দের তালিকায় চলে এসেছে। কেন বলো তো?’ আমি বললাম, আপনার স্ত্রীর আপনার প্রতি আন্তরিকতা আর ভালোবাসার জন্য। মনোয়ার সাহেব বললেন, ‘ঠিক তাই। সত্যি বলতে কি, সম্পর্ক অনেকটা চারা গাছের মতো। নিয়মিত পরিচর্যা যেভাবে ছোট্ট চারা গাছকে একদিন বিশাল মহিরুহে পরিণত করে, নিয়মিত যত্ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। তোমাদের এসব বললে তোমরা বলো, আমরা সেকেলে, তোমরা আধুনিক। আর আমার নাতি-নাতনিদের বললে ওরা বলে, জেনারেশন গ্যাপ। এসব আসলে কিছুই না। ভালোবাসা, আন্তরিকতা, দায়িত্ববোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একই রকম থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার ধরন পাল্টায়।’

আমার সহকর্মী তিতির, উচ্ছল প্রাণবন্ত স্বভাবের মেয়ে। সেদিন মুখ গোমড়া করে বসে আছে দেখে জানতে চাইলাম, ব্যাপার কী? সে কপট রাগ করে বলল, ‘বিয়ে হয়েছে মাত্র দুই বছর। এর মধ্যেই রাকিব (তিতিরের স্বামী) আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভুলে গেছে।’ বললাম, কাজের চাপ বেশি বোধ হয়। সে বলল, কাজ কোনো ইস্যু না। আসলে ইচ্ছেশক্তির অভাব। তা না হলে বছরে একটামাত্র দিন সেটা মনে রাখা এত কষ্টকর হবে কেন! আমি বললাম, ভুলে যাওয়াটা তো স্বাভাবিক, মানুষ তো আর রোবট নয়। তিতির এবার খেপে গিয়ে বলল, হ্যাঁ, ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক মানলাম। কিন্তু নিজে মনে রাখতে না পারলে মোবাইলে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখলেই পারে!

এই কথা অবশ্য ঠিক। অবস্থা খুব একটা সুবিধার নয় দেখে আমি চুপ করে রইলাম। বাকি দিনটা তিতির তিরিক্ষি মেজাজ নিয়েই পার করে দিল।

রাতে হঠাৎ তিতিরের ফোন। খুশি খুশি গলায় বলল, ‘আপু, একটা রিকোয়েস্ট ছিল।’ আমি বললাম, বলে ফেলো। তিতির বলতে লাগল, ‘আমার কালকের বিকেলের ডিউটিটা তুমি একটু করে দেবে, প্লিজ।’ আমি বললাম, শরীর খারাপ? তিতির হেসে বলল, ‘আরে নাহ্। আমরা একটু ঢাকার বাইরে যাব, তাই।’ আমি বললাম, ঝামেলা মিটে গেছে তাহলে? তিতির বলল, ‘আর বলো না, বাসায় এসে মন খারাপ করে বসে আছি। এমন সময় রাকিব হাজির আর হাতে বিভিন্ন রঙের অনেক অর্কিড। তুমি তো জানোই, অর্কিড আমার খুব পছন্দের। অর্কিডের লোভে পড়ে এবারের মতো ওকে মাফ করে দিয়েছি। তবে আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছি, পরবর্তী সময়ে এমন করলে আর রেহাই নেই।’

সকালে যে ছিল ভীষণ মনমরা, রাতে সেই আনন্দে ভাসছে। উপলক্ষ খুব বড় কিছু না। কিছু পছন্দের ফুল আর কিছুটা সময় নিজেদের মতো করে কাটানো, ব্যস। মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য বড় বড় কারণ জড়িত থাকে খুব কম। এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট ব্যাপার বা ঘটনাই জড়িয়ে থাকে বেশি। কারণ, মানুষ বড় বড় ইস্যুর ব্যাপারে সচেতন থাকে এবং সেগুলোকে যথাসম্ভব গুরুত্বও দেয়। আর এদিকে দেখা যায় ছোট ছোট অবজ্ঞা বা অবহেলা জমতে জমতে একসময় আকাশ ছুঁয়ে ফেলে মনের অজান্তেই। তাই ছোট ব্যাপারে মনোযোগ জরুরি।

মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মিনগন ম্যাকলফলিন বলেছেন, ‘একটি সফল বিয়ে মানে বারবার একই মানুষের প্রেমে পড়া। ‘সত্যিই তো, প্রিয় মানুষের প্রেমে বারবার পড়লে ক্ষতি কী! আর বলে–কয়ে কিংবা ঢাকঢোল পিটিয়েই যে প্রেমে পড়তে হবে, এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই। একজনের অজান্তেই আরেকজন তাঁর পছন্দনীয় কিছু করুন। সম্পর্ককে সব সময় সজীব রাখার চেষ্টা করুন ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে। পেশা বা কাজের প্রয়োজনে হয়তো দুজন দূরে আছেন। একটু সময় বের করে তাকে ফোন দিন দুপুরের খাবার খেয়েছে কি না। চা বা কফি পানের সময় একটা ছোট্ট মেসেজ—সে কী করছে।

পড়ন্ত বিকেলে একা একা বিরক্ত বোধ করছেন অথবা তাঁকে মিস করছেন, নিঃসংকোচে প্রিয় মানুষটিকে জানান আপনার মনের কথা। বিশেষ দিনগুলো যেমন, জন্মদিন, প্রথম সাক্ষাতের দিন, বিবাহবার্ষিকী অথবা অন্য কোনো বিশেষ আয়োজন মনে রাখুন। আপনি খুব ব্যস্ত, মনে রাখা সম্ভব নয়; তাহলে মোবাইল ফোনে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন। সময় করে বছরে অন্তত একবার দুজন মিলে দূরে কোথাও ঘুরতে যান, নিজেদের সাধ্যের মধ্যেই। তা না পারলে কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসুন। বছরের কিছুটা সময় দুজন মিলে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করুন, মন ভালো হবে। একঘেয়েমিকে দূরে ঠেলে দিন।

প্রতিদিন নতুন কিছু করুন, খুব ছোট কিছু হলেও। কারণ, বিন্দু বিন্দু জল নিয়েই মহাসাগরের সৃষ্টি। ছোট ছোট আনন্দই একদিন মহাকাব্যের সৃষ্টি করবে আপনাদের জীবনে। ভালোবাসার মানুষকে খুব বড় বা দামি কিছু উপহার দিতে হবে এমন নয়। আপনি তাঁকে বুঝতে শিখুন, তাঁর আবেগকে সম্মান করুন। একে অপরকে সময় দিন, ভালোবাসুন, বিশ্বাস রাখুন। সিরিয়াস ঝগড়া–বিবাদের বদলে মজার খুনসুটিতে মেতে উঠুন। দেখবেন জীবন সুন্দর, দাম্পত্য বৈচিত্র্যপূর্ণ, সংসার আনন্দময়।

লেখক: চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।