কুড়িতে আরও উজ্জ্বল

এখনো ক্লান্তিহীন বারিধারা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি গায়ে মেখে বারো মাসে তেরো পার্বণকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত সবাই। এদিকে শীতও কিছুদিন পর হামাগুড়ি দেবে। আর শীত মানেই মন যেন করে ওঠে ‘বেরু বেরু...’। তবে উৎসব হোক বা শীত, মনের মতো পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে তুলতে কে না চান। আর তারই সুলুক সন্ধান নিয়ে এবারও রংবেরঙের পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছিল ল্যাকমে। মুম্বাইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে বসেছিল পাঁচ দিনের ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক উইন্টার/ ফেস্টিভ ২০১৯’। এবার ২০ বছরে পা দিল এই আয়োজন।

শীতে থাকবে উজ্জ্বল রং
শীতে থাকবে উজ্জ্বল রং


ফ্যাশনের দূত
প্রতিবারের মতো এবারও ফ্যাশন উৎসবের প্রথম সকালে ল্যাকমের মঞ্চে জন্ম নিল একঝাঁক ফ্যাশনের দূত। আগামী ফ্যাশনের ধারা এঁরাই বহন করবেন। ‘আইএনআইএফডি’ আয়োজিত এই শোতে ছিলেন ছয় নবীন ডিজাইনার। লাদাখের পাহাড়ি শীতলতা থেকে দিল্লির উষ্ণতা—সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল এদিন। সাহিব ভাটিয়া, গৌরব সিং, অঙ্কিতা শ্রীবাস্তব, আকাঙ্ক্ষা আগরওয়াল, মঞ্জুশ্রী সাইকিয়া, স্ট্যাজিন পালমো—এই ছয় তরুণের পরিবেশন রীতিমতো প্রশংসনীয়। তবে এই ছয়ের মধ্যে সবচেয়ে নজর কাড়েন লাদাখের স্ট্যানজিন ও আসামের মঞ্জুশ্রী। স্ট্যানজিন পালমো তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে লাদাখের অপার সৌন্দর্য তুলে ধরেন। লাদাখের পশমিনা, লাদাখ উল, সিল্ক, সুতি, লিনেন, রেয়ন ব্যবহার করে এই তরুণী ডিজাইনার লাদাখি সাবেকি পোশাক ‘গোঞ্চা’র সঙ্গে পরিচয় করান সবাইকে।

আসামের শিল্পকলাকে তুলে ধরেন মঞ্জুশ্রী সাইকিয়া। তাঁর ‘উরা মাকু’ আয়োজনে ছিল এরি, মুগা সিল্ক, অরগ্যানিক সুতি এবং চান্দেরির মিডি র‍্যাপ স্কার্ট, ল্যাপেল-লেস জ্যাকেটের সঙ্গে প্যান্ট, প্যান্টের সঙ্গে কোট-ড্রেস।

ডিজাইনার জয়ন্তী রেড্ডির পোশাকে অভিনয়শিল্পী পূজা হেজ
ডিজাইনার জয়ন্তী রেড্ডির পোশাকে অভিনয়শিল্পী পূজা হেজ


সুতি-কথা
ল্যাকমের দ্বিতীয় দিন ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে’। তাই ঝাঁ-চকচকে ল্যাকমের মঞ্চে আধুনিকতা আর গ্রামীণ আবহ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। এদিন উৎসবের আঙিনাজুড়ে ছিল শুধুই মাটির গন্ধ। খাদি ইন্ডিয়া এই মঞ্চে নিয়ে আসে তিন ডিজাইনার অনুজ ভুটানি, পল্লবী ধ্যানী এবং গৌরব খানিজোকে। সুতি, খাদি সিল্কের সাবেকি থেকে হাল ফ্যাশনের ট্রেন্ডি পোশাক নিয়ে আসেন তাঁরা।

এবারও নজর কাড়ে স্টেফানো ফুনারি ও পূর্ণিমা পান্ডের ‘আই ওয়াজ আ শাড়ি’। ছয় বছর ধরে তাঁরা ফেলে দেওয়া শাড়ি দিয়ে নতুন নতুন সৃষ্টিতে মগ্ন। পুরোনো শাড়ি দিয়ে স্টেফানো এবং পূর্ণিমা স্টাইলিশ পোশাক, জুতো, ব্যাগ, পাগড়িসহ নানা জিনিস বানিয়েছেন।

ডোরাকাটা নকশা আবার দেখা যাচ্ছে ফ্যাশনে
ডোরাকাটা নকশা আবার দেখা যাচ্ছে ফ্যাশনে


বিয়ের সাজ
বিয়ের সাজ মানেই আবেগ দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে তোলা। ফ্যাশন মঞ্চে নামজাদা ডিজাইনাররা হাজির করেছিলেন বিয়ের সাজের নতুন কথা। গৌরাঙ্গ শাহ, অর্পিতা মেহেতা, অনুশ্রী রেড্ডি, জয়ন্তী রেড্ডিদের ডিজাইন করা শাড়ি, লেহেঙ্গা-চোলিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল ল্যাকমের আসর। ব্যান্ড পার্টির বাদ্য, বিয়ের গান আর তার সঙ্গে কনেরূপী একঝাঁক সুন্দরী সব মিলিয়ে বিয়ের উষ্ণতা নেমে এসেছিল ল্যাকমের আনাচকানাচে।

প্রতিবারের মতো এবারও মুগ্ধ করে গৌরাঙ্গ শাহের অভিনব আয়োজন। তাঁর ‘পেশওয়াই’ সংগ্রহে ছিল শাড়ি, লেহেঙ্গার বৈচিত্র্য। গৌরাঙ্গের পোশাকে পৈঠানি, খাদি জামদানি, কোটা, বাঁধনি সব মিলেমিশে এক হয়ে জন্ম নিয়েছিল ফ্যাশনের এক নতুন রূপকথা। গৌরাঙ্গের শাড়ি, লেহেঙ্গার সঙ্গে খোঁপায় ফুলের মালা, সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে আর হাতে সবুজ চুরি পরে সেজে উঠেছিলেন মডেলরা।

অভিনয়শিল্পী তারা সুতারিয়া ডিজাউনার রিতু কুমারের পোশাকে
অভিনয়শিল্পী তারা সুতারিয়া ডিজাউনার রিতু কুমারের পোশাকে

এদিকে জয়ন্তী রেড্ডির আয়োজনে ছিল র সিল্ক, বেনারসি, শির অরগেঞ্জা এবং নেট দিয়ে আনারকলি, লেহেঙ্গা-চোলি, লম্বা ঝুলের কুর্তা, ধুতিসহ বিয়ের অনুষ্ঠানের পোশাকের নানান বাহার। অনুশ্রী রেড্ডির ‘গুলাল’ আয়োজনে ছিল ভারী জারদৌসি, কাতানা ও মুক্তোর কাজ। অরগ্যাঞ্জা, সিল্ক, র সিল্কের উজ্জ্বল লাল, শ্যাম্পেন গোল্ড, পিঙ্ক রঙের লেহেঙ্গা-চোলি ছিল তাঁর সম্ভারে।

ডিজাইনার অর্পিতা মেহেতা বিয়ের মেহেন্দি, সংগীত, মালাবদল সব অনুষ্ঠানের পোশাকের বাহার হাজির করেছিলেন তাঁর প্রদর্শনে। তিনি তাঁর আয়োজনে রং নিয়েও খেলা করেছেন। হালকা রঙের পোশাকেও যে কনে হয়ে উঠতে পারেন অপরূপা, তা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন। আহের, মিরর, এমব্রয়ডারিসহ নানান কাজের হাল ফ্যাশন এবং সনাতন পোশাকের মেলবন্ধন ঘটিয়ে অর্পিতা সবার নজর কাড়েন।

র‌্যাফল থাকবে সব ধরনের পোশাকেই
র‌্যাফল থাকবে সব ধরনের পোশাকেই


চলো যাই
শীত মানেই বাক্স-পেটরা গুছিয়ে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তাই সফরপ্রেমীদের জন্য ল্যাকমে সন্ধান দিল নানান পোশাকের বাহার। ‘যাযাবর’-এর বাঙালি ডিজাইনার নীলাঞ্জন ঘোষ এবং কানিকা সচদেব তাঁদের আয়োজনে রেখেছিলেন মধ্যবিত্তের ভ্রমণকালীন পোশাকের বৈচিত্র্য। তাঁদের ‘চায় অ্যাট মুঘলসরাই জংশন’ সংগ্রহে উঠে আসে নানান জীবজন্তু, কিছু ব্যস্ত স্টেশনের নাম, তাজমহল, কারিঘর, মিনিয়েচার, আর্কাইসহ আরও অনেক কিছু। খাদি, সিল্ক চান্দেরি, অরগ্যাঞ্জা, জামদানি, তসর, জর্জেট, চান্দেরির ওপর বেনারসি তাঁতের নানান ধরনের জ্যাকেট, টিউনিক, লেয়ার স্কার্ট, কিমানো, লেয়ার শাড়ি ছিল তাঁদের পরিবেশনায়।

হুডওয়ালা পাতলা জ্যাকেট শীত সম্ভারে নিয়ে আসছে ভিন্নতা
হুডওয়ালা পাতলা জ্যাকেট শীত সম্ভারে নিয়ে আসছে ভিন্নতা

জনপ্রিয় ডিজাইনার রিতু কুমার এবার ল্যাকমের মঞ্চে নিয়ে আসেন সফরকালে হালকা অথচ হাল ফ্যাশনের পোশাক। নারী ঘোড়সওয়ারির জন্য নতুন ধারার পোশাক এনে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। শীত মানে সোয়েটার—এ ধারা ভাঙলেন ডিজাইনার অনুরাগ গুপ্তা। হুডতোলা লং ফ্রক, হুডতোলা জাম্প স্যুট, হুডওয়ালা জ্যাকেট, স্ট্রেট প্যান্ট, ফুল স্লিভ টপসহ আরও অনেক কিছু ছিল তাঁর পরিবেশনে। তবে অনুরাগের এই আয়োজন ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে কাপড়ের বেল্টের বৈচিত্র্যে। তিনি ডেনিমকে পুনর্ব্যবহার করে ফ্যাশনের এক নতুন দিশা খুলে দেন।

ল্যাকমের মঞ্চে শেষ দিনের শেষবেলায় ডিজাইনার রীনা ঢাকা আবার প্রমাণ করলেন ফ্যাশন সবার জন্য। তাই স্থূলকায় ফ্যাশনপ্রেমীদের জন্য নিয়ে তিনি আসেন সাহসী পাশ্চাত্য পোশাকের নমুনা।

পালাজ্জো দেখা যাবে এই শীতেও
পালাজ্জো দেখা যাবে এই শীতেও


প্রথম ও শেষ রজনী
ল্যাকমে ফ্যাশন উৎসবের শুভসূচনা হয় অত্যন্ত খ্যাতনামা ডিজাইনার মনীশ মালহোত্রার শোর মাধ্যমে। উৎসবের শুরুর রাতই জমকালো হয়ে ওঠে বলিউড সুন্দরী ক্যাটরিনা কাইফের দ্যুতিতে। এই রাতে তাঁর পরনে ছিল মনীশের ডিজাইন করা কালো রঙের লেহেঙ্গা-চোলির ওপর রুপালি জরির কাজ। ল্যাকমের শেষ দিনের শেষ রাতেও কালো পোশাকে মোহময়ী হয়ে উঠেছিলেন আরেক বলিউড তারকা কারিনা কাপুর খান। গৌরী-নয়নিকা তাঁদের আয়োজনে আশির দশকের সাহসী লুক তুলে ধরেন। কালো গাউন পরে কারিনা ল্যাকমের শেষ রাতকে আরও উজ্জ্বলময় করে তোলেন।

এবার ল্যাকমের আয়োজকেরা হলো লাভ অ্যান্ড কেয়ার, আইএনআইএফডি, খাদি ইন্ডিয়া, নেক্সা, আরআই এলান, #স্ট্রিটফিট, ক্যাপ্রিসি, সিম্বা, স্মার্টওয়াটার, ল্যাকমে স্যালন, ‘দ্য রিয়েল কাট ডায়মন্ড’, বোটসহ আরও অনেকে।