সবাই মিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ

জীবন রঙিন সুন্দর। তাই সব সময় ইতিবাচক ভাবনা ভাবুন। মডেল: ছবি: অধুনা
জীবন রঙিন সুন্দর। তাই সব সময় ইতিবাচক ভাবনা ভাবুন। মডেল: ছবি: অধুনা

১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৪০ জন আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির মতে, আত্মহত্যা বিশ্বে ১৫-২৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলেও যেকোনো বয়সেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যিনি কোনো রকম মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে মানসিক সমর্থন দিতে পারে পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীরা। তাঁকে বোঝাতে হবে, তাঁর পাশে আপনারা আছেন। দরকার মনে হলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। 

আত্মহত্যার কারণ
মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই বেঁচে থাকার প্রবণতা রয়েছে। দুঃসহ জটিল অবস্থার মধ্যেও আমরা বেঁচে থাকতে চাই। দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের এক বিরাট অংশ আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছিল। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব (৫০%), বিষণ্নতা রোগ (৬%), মাদকাসক্তি (৭%) ও অন্যান্য জটিল মানসিক রোগ (সিজোফ্রেনিয়া) অন্যতম। সম্পর্কজনিত জটিলতা, যেকোনো ব্যর্থতা (প্রেমে প্রত্যাখ্যাত, বিচ্ছেদ, পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, আকস্মিকভাবে সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন), কষ্টকর শারীরিক রোগ ইত্যাদি কারণে অনেকে আত্মহত্যা করলেও এ ধরনের আত্মধ্বংসী প্রতিক্রিয়া কখনোই স্বাভাবিক নয়।

আত্মহত্যা মানুষ কেন করে, সেই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, ব্যক্তির জিনগত বৈশিষ্ট্য, মানসিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশ ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের জটিল মিথস্ক্রিয়া এর জন্য দায়ী। সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরহিমের মতে, মানুষ যখন অন্যদের সঙ্গে একাত্ম বোধ না করে বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে, সেই বিচ্ছিন্নতা আত্মহত্যার অন্যতম ঝুঁকি। সমস্যা মোকাবিলায় অদক্ষতা, হীনম্মন্যতা ইত্যাদি ছাড়াও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি, অথবা যারা আবেগের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় বা সহজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। 

আত্মহত্যা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
পৃথিবীর সবখানেই আত্মহত্যা নিয়ে কিছু মিথ বা ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন মনে করা হয়, ‘যারা মুখে আত্মহত্যার কথা বলে বা হুমকি দেয়, তারা শুধু অন্যের মনোযোগই আকর্ষণ করতে চায়, তারা কখনোই আত্মহত্যা করে না’; ‘একবার আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি এর পুনরাবৃত্তি করবে না’; ‘আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। কারণ, সেটা আত্মহত্যাকে উসকে দেয়’; ‘যারা আত্মহত্যা প্রকৃতভাবে করে ফেলে, তারা কোনোভাবেই অন্যকে জানায় না বা এর কোনো সতর্ক সংকেত রাখে না’। 

কিন্তু সঠিক তথ্য হলো, যারা আত্মহত্যা করেছে, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি অন্যের কাছে সুস্পষ্টভাবে তাদের আত্মহত্যার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। প্রতিটা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে ৩০ বারের বেশি নানাভাবে নিজেকে আঘাত করার ঘটনা ঘটে। ৪০-৬০ শতাংশ আত্মহত্যাকারী আত্মহননের আগেও সাধারণত চেষ্টা করেছে এবং ছয়জনের মধ্যে একজন এক বছরের মধ্যে পুনরায় চেষ্টা করে। আত্মহত্যা নিয়ে কথা বললে এটাকে উসকে দেওয়া হয় না, বরং এ নিয়ে কথা বললে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কষ্ট কিছুটা লাঘব হয় এবং এই সাহায্যের হাত ধরতে চায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আত্মহননকারী ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা রকম সতর্কসংকেত রেখে যায়। 

 আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়

● মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। 

● আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে সাবধানে রাখা। হাতের কাছে ছুরি, কাঁচি, ওষুধ না রাখা। তাকে একা না রাখা। 

● আত্মহত্যার সতর্কসংকেত সম্পর্কে জানা। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আত্মহত্যার কথা বলা বা হুমকি, একবার বা বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা, বিষণ্নতা রোগে ভোগা, হঠাৎ সবার কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ইত্যাদি। 

● গণমাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করা। যথাসম্ভব আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ ও ধরন বর্ণনা থেকে বিরত থাকা। 

● ক্রাইসিস সেন্টার ও টেলিফোন হটলাইন সারা দেশে চালু করা। 

● আত্মহত্যা প্রতিরোধ কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একক দায়িত্ব নয়। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যেক সদস্য সচেতন এবং একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করলেই এমন ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব। 

● আত্মহত্যায় ব্যবহৃত জিনিস সহজলভ্য না করা।

মেখলা সরকার, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।