একটু হাসুন

হাসলে শরীর ও মন ভালো থাকে। মডেল:  মাশিয়াত ও তৃণ, ছবি: কবির হোসেন
হাসলে শরীর ও মন ভালো থাকে। মডেল: মাশিয়াত ও তৃণ, ছবি: কবির হোসেন
হাসিই আপনার সৌন্দর্য, হাসিই আপনার আধুনিকতা, হাসিই আপনার স্মার্টনেস। হাসি কোনো হালকা বিষয় নয়, এটি একটি ‘সিরিয়াস’ বিষয়। তাই হাসুন—অট্টহাসি, মুচকি হাসি, যা–ই হোক, একটু হাসুন। 

‘রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,/ হাসির কথা শুনলে বলে, “হাসব না-না, না-না।”/ সদাই মরে ত্রাসে—ঐ বুঝি কেউ হাসে!’

​‘এই রে, হাসলেই বুঝি আমি খেলো হয়ে গেলাম। গেল গেল, আমার ব্যক্তিত্ব গেল’—এই ভেবে নিজের মধ্যে একটা নকল ভাব ধরে রাখতে অনেকেই রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকে। হাসির ঘটনায়ও হাসে না। যেন সব সময় কপাল কুঁচকে থাকা বিরক্ত এক ‘বড় কর্তা’। কিন্তু এই না হেসে থাকার চেষ্টা মোটেও ঠিক নয়। শরীরে আর মনের দিক থেকে ভালো থাকার জন্য হাসতেই হবে। যৌক্তিক কারণে অবশ্যই হাসতে হবে। হাসির এই ‘হা হা’, ‘হো হো’, ‘হি হি’ উচ্চারণগুলো হচ্ছে বিশ্বজনীন ভাষা! প্রায় সব ভাষাতেই হাসির বহিঃপ্রকাশ একধরনের। পৃথিবীতে মানুষ একমাত্র প্রাণী যে পরিপূর্ণভাবে হাসতে পারে। তবে শিম্পাঞ্জি, ইঁদুর, ডলফিন, কুকুরসহ বেশ কিছু প্রাণী তাদের বিভিন্ন আচরণে বা শব্দে আনন্দের ভাব প্রকাশ করতে পারে বলে গবেষকেরা প্রমাণ পেয়েছেন, কিন্তু সেটা হাসি নয়। আর হায়েনার হাসি বলে যেটা রয়েছে, সেটা আসলে হায়েনার ডাক।

হাসি কী?
হাসি হচ্ছে মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ভালো লাগা, খুশি, আনন্দ আর কোনো অর্জনের পর আমাদের মনে যে আবেগের সঞ্চার হয়, সেটা ফুটে ওঠে হাসির মধ্য দিয়ে। আমরা কিন্তু খুব সচেতনভাবে ‘এখন হাসতে হবে, সবাই হাসুন’ এমনভাবে হাসি না। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের উৎসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাসির প্রকাশ ঘটে। আর সচেতনভাবে ‘হাসতে হবে’, তাই মনে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে রাখাটা হচ্ছে কৃত্রিম হাসি। 

আবেগের কারণে মস্তিষ্কের ভেন্ট্রোমিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স উদ্দীপ্ত হয়, এর ফলে ‘এন্ডোরফিন’ নামক রাসায়নিক বস্তুর নিঃসরণ ঘটে, তাই আমরা হাসি। আবার অন্যভাবে ব্যাখ্যা দিলে আবেগের কারণে আমাদের মাংসপেশির সঞ্চালনায় হাসির উদ্রেক ঘটে, তখন মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন নিঃসরণ হয়। অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো অবস্থা। মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম আর এমিগডালা নামক অংশের সক্রিয়তাও হাসি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, হাসি আমাদের মনের উদ্বিগ্নতা দূর করে, রাগ আর দুঃখ দূর করে; তাই হাসির গুরুত্ব রয়েছে।

হাসি আমাদের অপরের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যম। কারণ, মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ সাধারণত একা একা হাসে না, অন্যদের সামনেই হাসে। হাসি কিন্তু সংক্রামক, অর্থাৎ আড্ডায় একজন হাসা শুরু করলে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। হাসির সময় আমাদের মুখ, গলা, ঘাড়, বুক, হাতের মাংসপেশির সঞ্চালন ঘটে, নিশ্বাস–প্রশ্বাসের পরিবর্তন হয়। স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে এমন একটি শিশু কথা শেখার আগেই হাসতে শেখে। সাধারণত জন্মের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে পারে, তবে জন্মের ছয় মাসের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে না পারলে ধরে নিতে হবে তার বিকাশ ধীরে হচ্ছে। শিশু দিনে প্রায় ১০০ বার হাসে আর পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন প্রায় ১০ বার হাসেন। হাসি নিয়ে গবেষণা অনেক। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়ে সাধারণভাবে আমরা বেশ কয়েক ধরনের হাসি দেখতে পাই—অট্টহাসি (জোরে শব্দ করে হাসা), মুচকি হাসি (শব্দহীন হাসা), কাষ্ঠ হাসি (কষ্ট চেপে হাসা), বাঁকা হাসি (ব্যঙ্গাত্মক হাসি), চাপা হাসি (যতটা খুশি ততটা প্রকাশ না করে মনে মনে হাসা), ক্রূর হাসি (প্রতিশোধের হাসি), মেকি হাসি (নকল, সাজানো হাসি) ইত্যাদি। 

হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায়। মডেল: ঐশী, ছবি: অধুনা
হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায়। মডেল: ঐশী, ছবি: অধুনা

কেন হাসব?
আমাদের হাসতেই হবে, কারণ হাসি একটি মানবিক আচরণ। সুস্থ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে হলে হাসতে হবে। দেহ আর মনে সুস্থ থাকতে হলে হাসির প্রয়োজন রয়েছে। ‘হাসি থেরাপি’ একধরনের ভালো থাকার পদ্ধতি। দেশ–বিদেশে হাসির ক্লাব রয়েছে, যে ক্লাবে শরীরচর্চার মতো দৈনিক দল বেঁধে হাসির চর্চা হয়! হাসির শারীরিক আর মানসিক উপকারিতা অনেক। হাসির কতগুলো প্রধান উপকারিতা হচ্ছে:

মানসিক চাপ দূর করে
হাসলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের (কর্টিসল) নিঃসরণ কমতে থাকে, ফলে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কম হয়। হাসিতে উৎকণ্ঠা ও উদ্বিগ্নতা কমে। 

ব্যথা কমায়
হাসি, বিশেষ করে অট্টহাসি এন্ডোরফিন নামক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটায়, যা আমাদের ব্যথার অনুভূতিকে হ্রাস করে। 

রাগ নিয়ন্ত্রণ করে
রাগ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায় হচ্ছে হাসার অভ্যাস করা। যত বেশি হাসবেন, তত বেশি রাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তৈরি হবে। 

রোগ প্রতিরোধ করে
হাসি রোগ প্রতিরোধক শ্বেতরক্তকণিকার উৎপাদন বাড়ায়, যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

অকালে বুড়োবেন না
হাসলে মুখের মাংসপেশির ব্যায়াম হয়ে যায়। ফলে যাঁরা নিয়মিত হাসেন, তাঁদের মুখে বার্ধক্যের ছাপ পড়ে না।

চিন্তাভাবনাকে শাণিত করে
হাসলে ফুসফুসে আর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ে, ফলে চিন্তাভাবনাগুলো অনেক শাণিত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাগুলো সুসংহত হয়।

সম্পর্কের উন্নতি ঘটে
একাধিক মানুষ যখন একসঙ্গে হাসে, তখন তাদের মধ্যে একটা কার্যকরী যোগাযোগ তৈরি হয়, পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। 

আত্মবিশ্বাস বাড়ায়
হাসলে যোগাযোগদক্ষতা বাড়ে, তাতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

ইতিবাচকভাবে ভাবায়
হাসি নেতিবাচক চিন্তা আর আচরণ থেকে দূরে রাখে, মানুষকে ইতিবাচক করে তোলে। 

মনে আনে নতুন শক্তি
হাসির মধ্য দিয়ে ক্লান্তি, অবসাদ দূর হয়। 

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
হাসি উচ্চ রক্তচাপ কমায়; যা হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। 

ওজন কমায়
প্রতিদিন ১৫ মিনিট হাসলে প্রায় ৪০ ক্যালরি শক্তি পোড়ে, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।

কাজের মান বাড়ায়
হাসলে টিমওয়ার্ক ভালো হয়, তাতে কর্মক্ষেত্রে কাজের মান বেড়ে যায়। টিমের বা দলের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব কম হয়।

আয়ু বাড়ায়
নরওয়েতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাসি মানুষকে দীর্ঘায়ু করে!

হাসির ব্যাকরণ যত

হাসি উপকারী, হাসি জরুরি; কিন্তু হাসিরও কিছু আদবকেতা রয়েছে। একা একা হাসবেন না, বিনা কারণে হাসবেন না। কারণ, বিনা কারণে হাসা বা একা একা হাসা কখনো মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। জোরে অট্টহাসি দেওয়ার সময় সতর্ক থাকুন আপনার হাসি কাউকে বিরক্ত করছে কি না। কোনো ছোট হাসির ঘটনায় এমনভাবে হাসবেন না, যাতে মনে হয় আপনি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছেন। পরিস্থিতি বুঝে হাসুন। যতটুকু সম্ভব মেকি, ক্রূর আর বক্র হাসি পরিহার করুন। কখনো কারও বিপদ দেখে হাসবেন না। 

‘এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি 

হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্​লামি।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভাবার কোনো কারণ নেই যে হাসি আপনার ব্যক্তিত্বকে খেলো করবে; বরং যৌক্তিক হাসি প্রমাণ করে আপনি একজন মানুষ, সুস্থ মানুষ। হাসিই আপনার সৌন্দর্য, হাসিই আপনার আধুনিকতা, হাসিই আপনার স্মার্টনেস। হাসি কোনো হালকা বিষয় নয়, এটি একটি ‘সিরিয়াস’ বিষয়। তাই হাসুন, অট্টহাসি, মুচকি হাসি, যা হোক একটু হাসুন। যেভাবে খুশি সেভাবে হাসুন। হাসতে আপনাকে হবেই!

আহমেদ হেলাল
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।