মন্দির, গুহা, সমুদ্র আর চিল্কায় সকাল

ওডিশার বিখ্যাত চিল্কা হ্রদে চলছে নৌকা। ছবি: প্রণব বল
ওডিশার বিখ্যাত চিল্কা হ্রদে চলছে নৌকা। ছবি: প্রণব বল

ভারতের ওডিশা রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগসূত্রের মাধ্যম বঙ্গোপসাগর। প্রতিবছর অকাল-বর্ষা কিংবা উত্তর-বর্ষায় সমুদ্রে ঝড় ওঠে। সেই ঝড়ের বেশির ভাগই হয় বাংলাদেশ উপকূল, নয়তো ওডিশা উপকূলে আঘাত হানে। এ যেমন সর্বশেষ ঝড় ফণী পুরো লন্ডভন্ড করে দিয়েছে ওডিশাকে। বিশেষ করে ওই রাজ্যের জেলা পুরীকে। বাংলাদেশ দিক থেকে ঘুরে সেখানে আঘাত হানে ফণী।

এ রকম দুর্যোগেই একটা সেতু রচনা করেছে দুদেশের উপকূলের মানুষ। যেন অনেক দিনের একটা আত্মীয়তা, এক নিদারুণ দুর্যোগ-দুঃখের সঙ্গী হিসেবে। অজান্তেই জন্মেছে অব্যক্ত ভালোবাসা। তবে সমুদ্র কি শুধু কেড়ে নেয়! সমুদ্রের বিশালতায় কত প্রাপ্তি, তা ওডিশা আর পুরী ভ্রমণ না করলে টের পাওয়া যাবে না। আসলে প্রকৃতিপ্রেমী, তীর্থযাত্রী, সাধারণ পর্যটক কিংবা সমুদ্রপ্রেমীদের এক সুতোয় বাঁধতে পারে পুরী। এ ছাড়া সাদা বাঘ দেখতে হলে যাওয়া যায় ভুবনেশ্বরের পাশে নন্দনকানন চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কে। ভুবনেশ্বরের পাশে আদিবাসী জাদুঘরও সমৃদ্ধ।

পুরীর জগন্নাথ মন্দির। ছবি: প্রণব বল
পুরীর জগন্নাথ মন্দির। ছবি: প্রণব বল

ওডিশার রাজধানী ভুবনেশ্বর। এটাকে বলা হয় মন্দিরের শহর। চলতে ফিরতে মন্দির। বিশেষ করে ভুবনেশ্বর থেকে পুরী যাওয়ার পথে পথে মন্দিরের দেখা মিলবে। লিঙ্গরাজ মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ কোনারক সূর্য মন্দির সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। এ ছাড়া রয়েছে ঐতিহাসিক গুহা। খণ্ডগিরি ও উদয়গিরি গুহার গুরুত্ব ঐতিহ্যগতভাবে অসাধারণ। ১০ আগস্ট ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে গাড়িতে ১৫-২০ মিনিট চলতেই এই দুই গুহার দেখা মেলে।
উদয়গিরিতে আছে একটি গুহা। পাথর খুঁড়ে ১২৩ ফুট উঁচুতে বৌদ্ধ সাধুদের বসবাসের জন্য উদয়গিরি নির্মাণ করা হয়। লালচে রঙের পাথরের ওপর টেরাকোটার কারুকাজ ওডিশার শিল্প ও সংস্কৃতিকে যেন তুলে ধরেছে।
উদয়গিরির পাশে খণ্ডগিরিও অনেক উঁচু। ১১৩ ফুট উঁচু এই জৈন সাধকদের এই গুহা রহস্যঘেরা। এখানে পাহাড়ের উঁচুতে সম্রাট অশোকের সঙ্গে কলিঙ্গ রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। আর যুদ্ধের পর অশোক এখানেই ধ্যানে বসেন।

পুরীর সমুদ্রে চলছে স্নান। ছবি: প্রণব বল
পুরীর সমুদ্রে চলছে স্নান। ছবি: প্রণব বল

কোনারক সূর্য মন্দির: কোনারক সূর্য মন্দির পুরী জেলার কোনারক শহর অবস্থিত। ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে সূর্যদেবের আরাধনার জন্য নরসিংহদেব এটি নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটি একটি বিশাল রথের মতো দেখতে। দেয়াল ও স্থাপনার গায়ে নানা কারুকাজ। রথের চাকার আদলে খচিত নানা কারুকাজ নজর কাড়ে। ভারতের সপ্তাশ্চর্যের একটি এই মন্দির। এ ছাড়া ইউনেসকো মন্দিরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ঘোষণা করেছে। মূল স্থাপনাটি এখন পরিত্যক্ত। তার পরও প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের মন্দিরটি দেখতে ছুটে যান।

জগন্নাথ মন্দির: তীর্থযাত্রীদের পুরী যাওয়ার মূলে থাকে জগন্নাথদেবের মন্দির দর্শন। ১০৭৮ সালে এই মন্দির নির্মিত হয়। ১১ আগস্ট মন্দির দেখতে হোটেল থেকে রওনা হই। ১০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই। ২১৪ ফুট উঁচু মন্দিরটির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার। একটা বিষয় লক্ষণীয়, পুরী কিংবা ওডিশার বেশির ভাগ মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী জগন্নাথ মন্দিরের আদলে।
রথযাত্রার সময় জগন্নাথ মন্দিরে প্রচুর লোকসমাগম হয়।

ভুবনেশ্বরের পাশে নন্দনকানন চিড়িয়াখানায় গেলে দেখা মেলে সাদা বাঘের। ছবি: প্রণব বল
ভুবনেশ্বরের পাশে নন্দনকানন চিড়িয়াখানায় গেলে দেখা মেলে সাদা বাঘের। ছবি: প্রণব বল

মন্দিরের শীর্ষে পতাকা বা ধ্বজা তোলার দৃশ্য দেখার জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থী জড়ো হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। চারজন লোক পতাকার থলে পিঠে বেঁধে কোনো সিঁড়ি ব্যবহার না করে মন্দিরের গায়ের খাঁজে পা দিয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। ওঠার সময় তাঁদের মুখ থাকে সামনের দিকে। পতাকা উত্তোলন করে একইভাবে নেমে পড়েন।

পুরী সৈকত: পুরী সৈকতের পানি স্বচ্ছ। ঢেউ বিশাল। ঢেউ আছড়ে পড়ছে সোনালি বালুচরে। শোঁ শোঁ শব্দ। সকাল-দুপুর-রাত সৈকতে মানুষ আর মানুষ। জলকেলিতে ব্যস্ত ছোট বড় সবাই। বালুচরে উট ও ঘোড়ার পিঠে চড়ছেন পর্যটকেরা। এখান থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয় দুটিই দেখা যায়।
তবে কোনার্ক শহরের কাছে চন্দ্রভাগা সৈকতও দেখা যায়। সেখানে স্বচ্ছ নীল পানির ঢেউ আছড়ে পড়ে বালুচরে। এই সৈকতে ভিড় মোটামুটি কম।
চিল্কা হ্রদ: ওডিশা যাবেন চিল্কা হ্রদ যাবেন না, তা হয়! তাই আমরাও বুদ্ধদেব বসুর কবিতার মতো এক সকালে রওনা হলাম চিল্কার উদ্দেশে। এশিয়ার বৃহত্তম হ্রদটি পড়েছে পুরী খুরদা ও গানজাম জেলার ১১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। হোটেল থেকে এক ঘণ্টার যাত্রাপথে পৌঁছে যাই চিল্কার পাড়ে, জেটিতে। ঘাটে বাঁধা ইঞ্জিন নৌকা। আড়াই হাজার থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে চিল্কা ঘোরার ব্যবস্থা আছে।

পাথর খুঁড়ে ১২৩ ফুট উঁচুতে বৌদ্ধ সাধুদের বসবাসের জন্য উদয়গিরি নির্মাণ করা হয়। ছবি: প্রণব বল
পাথর খুঁড়ে ১২৩ ফুট উঁচুতে বৌদ্ধ সাধুদের বসবাসের জন্য উদয়গিরি নির্মাণ করা হয়। ছবি: প্রণব বল

একটি নৌকা ভাড়া করে ছুটলাম ডলফিনের সন্ধানে। স্বচ্ছ জলরাশির ওপর যেতে যেতে কখনো পাশে সবুজ পাহাড়, কখনো পানিতে পাখির ওড়াউড়ি দেখা যায়। তবে শীতকালে বেশি অতিথি পাখির দেখা মেলে হালকা লোনা জলের এই হ্রদে।
প্রায় দেড় ঘণ্টা চলার পর একটা জায়গায় ডলফিনের দেখা মিলল। সেখান থেকে আবার ঘণ্টাখানেক চলার পর একটি আইল্যান্ডে এসে নৌকা নোঙর করে। সেখানে কয়েকটি খাবারের দোকান রয়েছে। তাতে হ্রদ থেকে তোলা তাজা মাছ পাওয়া যায়। অর্ডার করলে সঙ্গে সঙ্গে রান্না করে দেওয়া হয়।
দোকানি শ্যামল জানালেন, ফণীতে দ্বীপটি ডুবে গিয়েছিল। তখন দোকানের চিহ্নমাত্র ছিল না। এখন আবার নতুন করে দোকান নির্মাণ করেছেন তাঁরা। দিনের বেলায় এই দ্বীপে দোকান করে সন্ধ্যায় ভূখণ্ডে ফিরে যান।
দ্বীপের পাশে চিল্কা মিশেছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে। হ্রদ আর সমুদ্রের সংগমস্থলটিও দেখে আসতে পারেন। সেখানে পানির দুটি ধারা। আর কবির মতো অস্ফুটে বলে উঠতে পারেন, ‘কী ভালো আমার লাগল আজ এই সকাল বেলা...।’

১১৩ ফুট উঁচু জৈন সাধকদের গুহা খণ্ডগিরি আজও রহস্যঘেরা। ছবি: প্রণব বল
১১৩ ফুট উঁচু জৈন সাধকদের গুহা খণ্ডগিরি আজও রহস্যঘেরা। ছবি: প্রণব বল