শিলং-চেরাপুঞ্জির দিনপঞ্জি

পাহাড়ের গা বেয়ে অপরূপ ঝরনাধারা। ছবি: লেখক
পাহাড়ের গা বেয়ে অপরূপ ঝরনাধারা। ছবি: লেখক

মাওলাইনং গ্রামে দুপুরের দিকে কেউ কেউ দোকানের ঝাঁপি খুলেছেন। কেউ কেউ করছেন গৃহস্থালির কাজ। গাড়ি থেকে গ্রামটিতে নেমে কিছুটা সময় লাগল ধাতস্থ হতে। গুগল যে তাপমাত্রার কথা জানিয়েছিল, অনুভূতি তো তার চেয়েও তীব্র। তবে গুগলের একটা তথ্য সঠিকই মনে হলো, মাওলাইনং এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম! প্রতিটি বাড়ির সামনেই সরু রাস্তায় পর্যটকদের জন্য ইটের সিঁড়ি, আর সব জায়গাতেই রাখা আছে বেতের তৈরি ময়লা ফেলার ঝুড়ি। ইচ্ছা করলেও ঝুড়ির বাইরে ময়লা ফেলার উপায় নেই। এ গ্রামের প্রাকৃতিকভাবে গাছের শিকড়ে তৈরি লিভিং রুট ব্রিজের একদিকে সবুজ গাছের শিকড়ের সেতুর টান অন্যদিকে প্রবহমান ঝরনা। ঝরনার জল গড়ানোর শব্দে ফরাসি কোনো বেহালাবাদকের মাতাল সুরের আবেশ। একটানা বেজেই চলেছে। ভারতের শিলংয়ের গ্রামের ঝরনার এই আবেশ নিয়েই ফিরতি পথ ধরেছিলাম।

গত ১০ আগস্ট বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম সকাল সাতটায়। এ ভ্রমণে আমরা মোট চারজন। গন্তব্য—তামাবিল-ডাউকি সীমান্ত পার হয়ে মেঘ-ঝরনার লীলাভূমি ভারতের শিলং-চেরাপুঞ্জি। যাত্রার পর প্রথম গন্তব্য মাওলিনং গ্রামে পৌঁছে যাই দুপুরের মধ্যে। গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করে ক্লান্তির ঘোর কাটতে শুরু করে।

এবার গন্তব্য শিলং শহর। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। রেস্তোরাঁর অনেকটা জায়গাজুড়ে সবুজ ঘাস, ঘাসের গালিচার মধ্যেই গোলটেবিল আর চেয়ার। হঠাৎ করে স্কটল্যান্ড ভেবে বসলেও যেন ভুল হবে না। চারপাশে যত দূর চোখ যায় বিস্তৃত সবুজ দিগন্ত আর নীলচে পাহাড়ের মেলবন্ধন। কিশোরী মেয়ের মতো মেঘের চাঞ্চল্য তো আছেই। খাবার সে–ও ছিল অমৃত। এমন পরিবেশে গা এলিয়ে অপরাহ্ণে চা পান না করে উঠে যাওয়া বাঙালির আদুরে দুপুর-স্বভাবের বৈপরীত্য! আমরাও পারিনি। চা খেতে খেতেই সূর্যটা গিয়ে এলিয়ে পড়ল পশ্চিম আকাশে। সময়ের হিসাব তো আর মাথায় ছিল না। মুঠোফোন, ক্যামেরা যে যার মতো চারপাশের সৌন্দর্যকে ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত ছিলাম তো। যাই হোক, এবার নির্দেশনায় কোনো বিরতি ছিল না, যাত্রা সোজা হোটেল। ততক্ষণে সন্ধ্যার বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছোট ছোট বাড়িগুলো আবছা দেখতে পাচ্ছি। শহরের কাছাকাছি গিয়ে মনে হলো, প্রকৃতিকে খুব বেশি না ঘাঁটিয়েই তার আদুরেপনা ও বেখেয়ালেই অস্তিত্ব বজায় রেখেই সেজেছে শিলং শহর।

শিলংয়ের উমিয়াম হ্রদের নীলাভ সৌন্দর্য মুদ্ধ করে পর্যটকদের।
শিলংয়ের উমিয়াম হ্রদের নীলাভ সৌন্দর্য মুদ্ধ করে পর্যটকদের।

নতুন জায়গায় এসে একেবারেই বিপদে না পড়লে চলে? আমাদের চালক নামিয়ে দিলেন গেস্টহাউসে। তবে, একটু সময় পরেই বুঝতে পারলাম, আমরা একই নামের অন্য একটি গেস্টহাউসে নেমে গিয়েছি বা চালক ভুল করে নামিয়ে দিয়েছেন। তবে গেস্টহাউসের মালিক নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন। আমাদের বুকিং দেওয়া অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের নম্বরে ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে দিলেন। পরে কম সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত ঠিকানায়। কিন্তু আবার মন খারাপের পালা। অনলাইনে ছবিতে যেমন দেখে বুকিং দিয়েছিলাম, আদতে তা নয়। তবে ক্লান্তিতে এত কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই, যে যার মতো ঘুমিয়ে গেলাম। পরের দিন ভোরেই জায়গা পরিবর্তন করে অ্যামেনিটিতে উঠে গেলাম, অর্থাৎ গত রাতে ভুল করে যেখানে উঠেছিলাম।

নতুন শহরে নতুন সকাল। আজকের গন্তব্য চেরাপুঞ্জি, সেভেন সিস্টার্স ফল। সকালের নাশতায় আলু পরোটার সঙ্গে ডিম ভাজি আর চা খেতে খেতেই গাড়ি হাজির।

রাস্তার চারপাশের পাহাড়ঘেরা সবুজ আবহ আর নির্জনতা। আমরা পৌঁছে গেলাম মেঘালয়কন্যা চেরাপুঞ্জিতে। চেরাপুঞ্জিতে বেলা-অবেলায় মেঘের খ্যাতি রয়েছে বৃষ্টি ঝরানোর। তবে আমরা বৃষ্টির দেখা পেলাম না। রোদেলা স্নিগ্ধতায় সাতটি ঝরনার নৈসর্গিক গানের তালে তালে চঞ্চল হয়ে উঠল আমাদের মন। ঝরনাগুলোর নিচের অংশে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে রংধনুর সাতটি রং। ঘোর লাগে এর অভাবনীয় সৌন্দর্যে।

দ্বিতীয় দিনের মতো যাত্রা শেষ। সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই শহরে ফেরার পালা। শহরে নয়টা বাজলেই থেমে যায় সব কর্মব্যস্ততা। রাতে ফ্রেশ হয়ে আমরা গেস্টহাউসের ডাইনিং রুমে বসলাম। আলুর দম, ডালমাখানি, ডিমের ঝোল আর মুরগির মাংস, রাতের ওই খাবারের স্বাদ জিবে লেগে আছে এখন অবধি।

মাওলাইনং গ্রামের সড়কগুলো এমনই।
মাওলাইনং গ্রামের সড়কগুলো এমনই।

রাতে ঘুমের কোনো ব্যাঘাত ঘটল না। সকালে ঘুম ভাঙল মাথার পাশের ছোট্ট জানালা দিয়ে আসা মিষ্টি রোদে। আর দূরপাহাড় থেকে আসা মলয় বাতাসের আবেশ তো ছিলই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম পাহাড়ে জেগে ওঠা আর শহরের মানুষদের নতুন দিনের সূচনাকর্ম। এটাই আমাদের মেঘ-পাহাড়ের শহরে শেষ সকাল।

নাশতা করেই ছুট লাগালাম গুয়াহাটির পানে। শিলং থেকে গুয়াহাটির দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। গুয়াহাটি যাওয়ার পথেই উমিয়াম লেকটাও দেখে নিলাম। লেকে বোট রাইডিংয়ের সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায় না। আর এর অভিজ্ঞতাও ছিল মাস্তিতে ভরপুর। তারপর আবার যাত্রা।

গুয়াহাটি পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। গুয়াহাটি শহরটি মন্দিরের জন্য খ্যাত। ব্রহ্মপুত্রের মাঝে অবস্থিত দ্বীপের মতো উমানন্দ মন্দির। সেখানে যেতেও হয় ছোট একটা লঞ্চে করে। শেষ বিকেলের শেষ ট্রিপের যাত্রী হয়ে আমরা উঠে পড়লাম। নদীর মাঝেই আমরা দিনের আলো নিভে যেতে দেখলাম। লঞ্চের ভেতরেই মিলছে বৈকালিক নাশতা আর চা। মন অসম্ভব স্থির। তাই খাবারের স্বাদের ভালোমন্দের হিসাব-নিকাশটাও নিরর্থক। চারদিকের শূন্যতা আর সন্ধ্যার আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটি অন্য রকম এক আবহ তৈরি করে রেখেছে। লঞ্চ থেকে নেমে মন্দিরে যেতে পেরোতে হলো অনেকগুলো সিঁড়ির ধাপ। পূজার মন্ত্র আর প্রবেশঘণ্টার শব্দ। বিশাল গাছগুলো আড়াল করে রেখেছে মন্দিরটি। অপার্থিব এই পরিবেশ থেকে আমরা লঞ্চে ফিরতি পথ ধরি। হোটেলে ঢোকার আগে আমাদের গাড়ির চালক আমোদ ভাইয়ের যাবতীয় হিসাব মিটিয়ে দিলাম। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই আমোদ ভাই নিজেদের দলের একজন হয়ে গিয়েছেন, অদৃশ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছে। এই হিসাব তো আর মেটানোর নয়। কিছু হিসাব থাক না মেলানোর খেরোখাতায়।

দুই গাছের জীবন্ত শিকড়ে তৈরি ‘লিভিং রুট ব্রিজ’।
দুই গাছের জীবন্ত শিকড়ে তৈরি ‘লিভিং রুট ব্রিজ’।

যাবেন যেভাবে

ঢাকা থেকে এসি বা নন-এসি বাসে করে সিলেট যাওয়া যায়। সিলেট শহরের কদমতলী থেকেই জাফলংগামী বাস পাওয়া যাবে। অথবা সিএনজি কিংবা প্রাইভেট কারেও তামাবিল যাওয়া যায়। সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। ইমিগ্রেশন পার হয়ে শিলং যেতে শেয়ারড ট্যাক্সি ও রিজার্ভড ট্যাক্সি অথবা গাড়ি পাওয়া যায়। ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ রুপিতে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে। আর শিলংয়ে ঘুরতে সাধারণত সারা দিন ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ রুপি নেয়। আমাদের শিলং-চেরাপুঞ্জি-শিলং (সারা দিন) নিয়েছিল ২ হাজার ৮০০ রুপি আবার শিলং থেকে গুয়াহাটি (সারা দিন) নিয়েছিল ২ হাজার ৮০০ রুপি।