এলিজার দেখা ৭

বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য দর্শনে বেরিয়েছিলেন এলিজা বিনতে এলাহী। গত আগস্ট মাসে এই পর্যটক ৬৪ জেলা ভ্রমণ সম্পন্ন করেছেন। তিনি তাঁর ঐতিহ্যযাত্রায় দেখা ব্যতিক্রমী ৭টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার কথা লিখেছেন।
কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনে এলিজা বিনতে এলাহী। ছবি: সংগৃহীত
কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনে এলিজা বিনতে এলাহী। ছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রথম রেলস্টেশনে, কুষ্টিয়া 
বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন কুষ্টিয়ার জগতি রেলওয়ে স্টেশন। ভারতের শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত দেশে প্রথম রেললাইন চালু হয় ১৮৬২ সালে। ওই সময় প্রথম স্টেশন হওয়ার জন্য এখানেই সব যাত্রী ওঠা-নামা করতেন। লোকসমাগমের কারণেই জগতি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি-রপ্তানির জন্য অন্যতম একটি স্থানে পরিণত হয় জগতি রেলওয়ে স্টেশন।

লোকজনের ভিড় সামাল দিতে একসময় এখানে ২৬ জন রেলওয়ে কর্মকর্তা–কর্মচারী কাজ করতেন। এখন সেই সংখ্যা নেমেছে এক কি দুজনে। আমি গিয়ে একজনকে পেয়েছি। লোকবলের অভাবে এখন স্টেশনের কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে। 

যে স্তম্ভ বেদিতে বসতেন রাজা, সিলেট
মেগালিথ। গ্রিক এই শব্দের অর্থ মহান পাথর। যুক্তরাজ্যের স্টোনহেঞ্জ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত মেগালিথ।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু মেগালিথ স্তম্ভ। ইতিহাস বলছে, এগুলো প্রাচীন জৈন্তাপুর রাজ্যের। জৈন্তাপুরের মেগালিথ নিয়ে লোককথা প্রচলিত আছে যে এই স্তম্ভগুলোর বেদিতে বসেই রাজা তাঁর দলপতিদের নিয়ে বিচারকাজ চালাতেন।

তবে পৃথিবীর বেশির ভাগ মেগালিথ স্তম্ভ যেহেতু মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাই ধরে নেওয়া হয় জৈন্তার এই স্তম্ভগুলো মৃত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত।

সুলতানি বণিকদের শহর, মুন্সিগঞ্জ
মিরকাদিম পৌরসভার অলিগলি ঘুরতে ঘুরতেই জানলাম নগর কসবার কথা। পুরো এলাকা আমার কাছে পানাম নগরীর মতো মনে হলো। শহরের মধ্যে আর একটি শহর। কিছু কিছু বাড়ির গায়ে ‘নগর কসবা’ লেখা আছে। অনেক ভবনের দেয়ালে বা ফটকে দেখতে পাই বণিকদের নাম। রাস্তার দুপাশে কারুকার্যময় ইমারতের কিছু অক্ষত, কিছু ধ্বংসপ্রায়, কিছু হয়েছে সংস্কার। এটি একসময় বণিকদের অভিজাত আবাসিক এলাকা ছিল।

কসবা সুলতানি আমলের প্রশাসনিক কেন্দ্র। সে সময় জেলাকে কসবা বলা হতো। মোগল আমলে অধিকাংশ কসবাই আগের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু বিক্রমপুরের এই কসবা গড়ে ওঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ঔপনিবেশিক আমলে। বণিকেরা গড়ে তোলেন বসতবাড়ি।

দক্ষিণের সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনা, যশোর
খুলনা-যশোর জেলা সীমান্তে কেশবপুর উপজেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ভরত ভায়না গ্রাম। সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক দেড় হাজার বছরের বেশি আগের এক পুরাকীর্তি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আজ অবধি আবিষ্কৃত স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনাটি এই সংঘারাম। বিশ্ব পর্যটক হিউয়েন সাং প্রাচীন বাংলা ভ্রমণের সময়, তাঁর ভ্রমণগ্রন্থে মোট ৩০টি সংঘারামের কথা উল্লেখ করেন। ভারত ভায়না এমনই একটি সংঘারাম। ভরত ভায়নার কথা আমি জেনেছি, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার বাংলাদেশের প্রত্নকীর্তি আর সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস বই থেকে।

একমাত্র বেলে পাথরের কূপে, ঠাকুরগাঁও 
গন্তব্যস্থানে গিয়ে প্রথমে চোখে পড়ল গোরকুই মন্দির লেখা একটি সাইনবোর্ড। ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখি এক সারিতে তিনটি সাধারণ মন্দির। মন্দিরগুলোর সামনে চার–পাঁচটি বেলে পাথরের টুকরা পড়ে আছে। বইয়ে অবশ্য পড়েছিলাম অসংখ্য বেলে পাথরের টুকরা মাটিতে ছড়িয়ে আছে। বেলে পাথরগুলো পার হয়ে একখণ্ড নিচু ভূমিতে বেলে পাথরের কূপটি দেখতে পেলাম। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে গোরকুই গ্রামে দেশের একমাত্র বেলে পাথরের কুয়া এটি। 

শ্যামনগরের হাম্মামখানা, সাতক্ষীরা
হাম্মামখানা বা স্নানাগার। মোগল আমলের মাত্র সাতটি হাম্মামখানা দেশের বিভিন্ন জেলায় টিকে আছে। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুরের হাম্মামখানাটি। মুসলিম সভ্যতায় প্রথম স্নানাগার বা হাম্মাম নির্মিত হয় এশিয়া মাইনর অঞ্চলে। ঈশ্বরীপুর হাম্মামটি স্থানীয়ভাবে হাবশিখানা নামে পরিচিত। এই হাম্মামখানার নির্মাণকাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, মোগল পর্বে অর্থাৎ সতেরো শতকের শুরুতেই এটি নির্মিত বলে ধারণা করে থাকেন।

দিঘির জলে গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ, নওগাঁ
বিস্ময়কর এক কীর্তি দিবর দিঘি স্তম্ভ। নওগাঁ জেলা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে পত্নীতলা উপজেলায় দিবর দিঘির মধ্যে অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের এ স্তম্ভটি আজও রহস্যময়। দিবর দিঘি ২০ একর জায়গাজুড়ে। দিঘির পাড় থেকে স্তম্ভটিকে বেশ দূরে মনে হচ্ছিল। ঘাটে নৌকা বাঁধা দেখে স্তম্ভটি ছুঁয়ে দেখার লোভ সংবরণ করা খুব মুশকিল ছিল আমার জন্য। গত বছর আধ ঘণ্টার জন্য সেই নৌকা ভাড়া করেছিলাম স্তম্ভটি কাছ থেকে দেখব বলে। 

ঐতিহ্যের খোঁজে ৬৪ জেলায়

সজীব মিয়া

সংগীতশিল্পী কবীর সুমন গানে গানে বলেছেন, ‘চল্লিশ পেরোলেই চালশে...’।  কিন্তু এলিজা বিনতে এলাহী চল্লিশে পা রেখেই যেন উদ্যমী হলেন। স্বভাবজাত প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে তিনি পথে নামলেন, গাঁটের পয়সা খরচ করে খুঁজে ফিরতে থাকলেন বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য। ২০১৬ সালের ১৭ মে ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে যে ঐতিহ্যযাত্রা শুরু করেছিলেন, কয়েক পর্বে ৬৪ জেলা ঘুরে তার শেষটা হলো গত ২৮ আগস্ট, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।

সময়ের হিসাবে যাত্রাটা একটু দীর্ঘ ভেবে বসেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য কারণটা এলিজা শুরুতেই বলে নিলেন, ‘আমি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। স্বামী ও এক ছেলে নিয়ে সংসার। তা ছাড়া এই সময়ের মধ্যে নেদারল্যান্ডসে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলাম। দ্য হেগ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসে ১৪ মাস কাটিয়েছি। এ কারণেই একটু সময় বেশি লেগেছে।’

সময়ের হিসাব রেখে আমরা বরং তাঁর কাছে শুনতে চাই ঐতিহ্যসন্ধানে তাঁর আগ্রহী হওয়ার কারণটা। জানা গেল, ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি ঝোঁকটা যে এলিজার ছোটবেলার। সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলে যান, ‘গল্প-কবিতা-উপন্যাস যত না আমাকে উদ্বেলিত করেছে, ঢের টেনেছে ইতিহাসের অজানা তথ্য। তাই হয়তো কোনো ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আমাকে খুব ভাবায়। সে জিনিসগুলো মনে করিয়ে দেয় মানুষের চিন্তা, মনন ও অসীম ক্ষমতার কথা।’

শুধু এই ভালো লাগার মন্ত্র নিয়েই তিনি পথে নামেননি, ঐতিহ্যসন্ধানে নেমেছেন আরও কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে। খোলাসা করে বললেন এলিজা, ‘আমি বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেখান থেকেই বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে ভেবেছি। এবার তো এ দেশের পর্যটনের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে গবেষণাই করলাম। আমার এ বিষয়ে দুটি গবেষণাপত্রও আছে। এই কাজ করতে গিয়েই
দেখেছি আমাদের পর্যটনশিল্প কতটা সম্ভাবনাময়। তাই আমি দেশের হেরিটেজ ট্যুরিজম বা ঐতিহ্যগত পর্যটনকে
জনপ্রিয় করার কাজে আগ্রহী হয়েছি। সম্ভাবনার কথা সবাইকে জানাতে এসেছি।’

সে কারণেই তিনি তাঁর যাত্রার নাম দিলেন ‘কোয়েস্ট: আ হেরিটেজ জার্নি অব বাংলাদেশ’। ব্যাকপ্যাক কাঁধে করতে থাকলেন ঐতিহ্যসন্ধান। নতুন কোনো জেলা ভ্রমণে যাবেন, খুলে বসতেন বিভিন্ন লেখকের বই। বইয়ের পাতার তথ্যগুলো মাথায় নিয়ে নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ঐতিহাসিক স্থাপনা, নিদর্শন, মিশেছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে। তাঁর এই সফর কোনোটা ছিল চার দিনের, কোনোটা তিন দিনের, কোনোটা দেড় দিনের। দিনভর ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যায় হাজির হতেন স্থানীয় সংগঠনের দপ্তরে। প্রথম আলো বন্ধুসভা, স্কাউট, ফটোগ্রাফি সোসাইটিসহ জেলার বিভিন্ন সংগঠনের তরুণ সদস্যদের নিজ জেলার গৌরবগাথা শোনাতেন। ঐতিহ্য পর্যটনের সম্ভাবনার কথা বলতেন।

এলিজা বিনতে এলাহী যেমনটি বলছিলেন, ‘এই বলার জন্যই তো আমি পথে নেমেছিলাম। এ যাত্রায় সারা দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থান ও স্থাপনাগুলোর ছবি তুলেছি, ভিডিও নিয়েছি। এসব আমার মতো করে প্রচার করব। উদ্যোগী হতে আগ্রহী করব কর্তৃপক্ষকে, সচেতন করব সাধারণ মানুষদের।’