কিশোরগঞ্জে হাওরের জলরাশিতে ঘোরাঘুরি

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর-বাঁওড়–নদীবেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জ। এই হাওর ঘিরে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে হাজারো মানুষের পদভারে মুখরিত থাকে হাওরাঞ্চল। হাওরে শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধূলিওড়া মেঠোপথও আকর্ষণ করে পর্যটকদের।

হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয়েক মাস এখানে শুকনাকাল।

কি শুকনা, কি বর্ষাকাল ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কিশোরগঞ্জের হাওর। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে কূলহীন সাগর। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে ছোট দ্বীপের মতো লাগে।

হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি হিজলগাছ মন কাড়ে যে কারও। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়।

বর্ষা–পরবর্তী শরতে হাওরে যখন পানি কমা শুরু হয়, তখন থেকেই আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাজার হাজার ধবল বকেরও ওড়াউড়ি শুরু হয়। দুলতে থাকে হাওরপারের সাদা কাশবন। আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখি। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা বিলে ফোটে সাদা শাপলা। শুষ্ক মৌসুমে পুরো হাওর হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। যেখানেই চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ।

বালিহাঁসের ওড়াউড়ি। কালিম, জলপিপি, ডাহুক, পানকৌড়ি ও জলময়ূরের অবগাহন দেখলে মোহিত না হয়ে পারা যায় না। শরতে পরিযায়ী পাখির আগমন হাওরকে আরও আন্দোলিত করে তোলে।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ—এ সাতটি জেলা মিলে হাওরাঞ্চল। এখানে ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে ৪২৩টি হাওর। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় রয়েছে বিশাল আকারের ১২২টি হাওর।

কিশোরগঞ্জের হাওরে পর্যটকদের দেখার মতো বেশ কিছু জায়গা রয়েছে। মিঠামইন উপজেলার কাটখাল ইউনিয়নের ‘দিল্লির আখড়া’ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। আখড়া ঘিরে এখানে রয়েছে শত শত হিজলগাছ। হিজলগাছের সারি তিন শ একরের আখড়া এলাকাজুড়েই। সারা বর্ষায় এগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ। এসব বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য। এসব বেড়িবাঁধে বর্ষায় হাজার হাজার পর্যটক এসে ভিড় জমান। প্রতি বর্ষাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন বেড়িবাঁধে।

এবারের বর্ষায় হাওরে দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল অন্য বছরের তুলনায় বেশি। দেশের দূরদূরান্ত থেকে মানুষ দল বেঁধে এসেছেন কিশোরগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন মনোরম স্থানে। বর্ষাজুড়েই ছিল ভ্রমণপিপাসুদের কোলাহল। উচ্ছ্বাস আর আনন্দে মাতোয়ারা ছিল হাওরাঞ্চল। এখনো রয়েছে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আনাগোনা।

গত সপ্তাহে ঢাকার কুড়িল এলাকার হাসমত মিয়া ও বাচ্চু মিয়া তাঁদের ১০-১২ জন বন্ধু নিয়ে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের বালিখলা ও নিকলীর বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘুরতে এসেছিলেন। কিন্তু হাওরে রাত যাপনের কোনো সুব্যবস্থা না থাকায় দিনের মধ্যেই তাঁদের ঢাকার উদ্দেশে কিশোরগঞ্জ ছেড়ে যেতে হয়। তাঁরা বলেন, হাওরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁদের বিমোহিত করেছে। যদি রাতযাপন ও শৌচাগারের সুব্যবস্থা থাকত, পরিবার–পরিজন নিয়ে অনায়াসে হাওরে বেড়ানো যেত।

বর্ষায় হাওরের বেশ কয়েকটি স্থানে দর্শনার্থীদের ঢল থাকে। এর মধ্যে করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়াঘাট, বালিখলা ও মিঠামইনের হাসানপুর সেতু, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক ও বেড়িবাঁধ, শিমুল বাঁকের হিজলবন, মিঠামইনের কামালপুরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি, দিল্লির আখড়া, নিকলী বেড়িবাঁধ, ছাতিরচরের করচের বন এবং তাড়াইলের হিজলজানি হাওর উল্লেখযোগ্য। এসব দর্শনীয় স্থানে এসে অসংখ্য পর্যটক হাওর দেখার পাশাপাশি ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার, গোসল, জলকেলিতে মাতেন।

বিশেষ করে নিকলীর বেড়িবাঁধে হাজার হাজার নারী-পুরুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাজানো নৌকায় ঘুরে বিশাল জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। এখান থেকে ছুটে যান ছাতিরচরের করচের বনে। নিকলীর বেড়িবাঁধে ঘুরতে আসা মোস্তাফিজ মারুফ বলেন, নিকলীর বেড়িবাঁধ ঘিরে পর্যটনের বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। হাওরে পর্যটন বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কিশোরগঞ্জে হাওরের পর্যটন বিকাশে সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই বলে তাঁর অভিযোগ।

কিশোরগঞ্জ জেলা হোটেল–রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শহর থেকে হাওরে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। সে জন্য দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেকেই শহরে রাত যাপন করেন। মৌসুমে হোটেলমালিকদের ব্যবসা ভালো হয়। তিনি বলেন, কিশোরগঞ্জ শহরে প্রায় ২০-২৫টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এবারের বর্ষায় এসব হোটেলে পর্যটক ছিলেন বেশি।

স্থানীয় ট্যুরিজম সংগঠন কিশোরগঞ্জ ট্র্যাকার্স ক্লাবের সভাপতি মারুফ আহমেদ বলেন, তাঁরা প্রতিবছর দেশের দূরদূরান্তের বিভিন্ন দুর্গম জায়গায় ভ্রমণে যান। কিন্তু সেসব জায়গায় ট্যুরিজমের পরিবেশ থাকায় তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু কিশোরগঞ্জে হাওরে দূরদূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী এসে নানা সমস্যায় পড়েন। কারণ, হাওরের কোথাও রাতযাপনের সুব্যবস্থা নেই। রাতে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা নেই।

মারুফ আহমেদ আরও বলেন, হাওরাঞ্চলে ভালো কোনো শৌচাগার নেই। ভালো নৌযানের ব্যবস্থা নেই। আবার ছোট নৌযানে শৌচাগারের সুব্যবস্থা নেই। রাতে হাওরপাড়ে থাকার নিরাপদ আবাসনব্যবস্থা না থাকায় দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকেরা শুধু দিনে নৌকা ভ্রমণ শেষে আবার ফিরে যান। তা ছাড়া, পরিবেশবান্ধব পর্যাপ্ত পর্যটনকেন্দ্র ও বিনোদনের ব্যবস্থাও নেই। যেহেতু হাওর ঘিরে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে, তাই সরকারের এসব বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

যোগাযোগ করলে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, এবার বর্ষায় কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওর ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনায় মনে হয়েছে, সবাই যেন এসব হাওরকেই ভ্রমণের প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। হাওরে ভ্রমণকে আরও পরিবেশবান্ধব করতে হবে।