সাদা-লালে অকালের বোধন

পূজায় লাল–সাদার আবেদন চিরন্তন। মডেল: বিদ্যা সিন্‌হা মিম। ছবি: নকশা
পূজায় লাল–সাদার আবেদন চিরন্তন। মডেল: বিদ্যা সিন্‌হা মিম। ছবি: নকশা

সেই কবে, কোনো এক শরৎকালে অকালে বোধন করে আদ্যাশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন রাম। আশা ছিল, তাঁর কাছে বর নিয়ে রাবণ বধ করে সীতাকে লঙ্কার অশোক বন থেকে উদ্ধার করবেন। সীতা উদ্ধার পেয়ে রামের সঙ্গে ফিরেছিলেন অযোধ্যায়। আর আদ্যাশক্তি মহামায়ারূপী দেবী দুর্গা এসেছিলেন বাংলায়—মাতৃরূপে, কন্যারূপে। বাল্মীকির আখ্যান কিঞ্চিৎ বদলে গিয়ে এই আখ্যান বাংলায় প্রচার পেয়েছিল কৃত্তিবাসী রামায়ণ–এর হাত ধরে।

শাস্ত্রে যা-ই থাক, বাঙালি হিন্দু দেবী দুর্গাকে গ্রহণ করেছে পার্বতীরূপে, উমারূপে। পর্বতের কন্যাকে নিজের কন্যার রূপেই দেখে বাঙালি। বছরান্তে বাঙালি নারী যেমন স্বামী–শ্বশুরের বাড়ি থেকে সন্তান-সন্ততিসহ বাপের বাড়ি নাইওর আসে, বাঙালি ভক্তের কল্পনায় দেবী দুর্গাও তেমনি বাপের বাড়িরূপ মর্ত্যে আসেন। মেয়ে বাপের বাড়ি এলে বাপ-মায়ের চেয়ে বেশি আনন্দ আর কার? তাই শুরু হয় উৎসব। এই উৎসবে যত না পরকালের জন্য কর্ম থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে ইহকালের জন্য প্রার্থনা।

বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে আসার বাঙালি সংস্কৃতি যাঁরা জানেন, তাঁরা বিলক্ষণ বোঝেন যে এ সময় সবকিছুর কেন্দ্রে থাকে মেয়ে। উপহারে-উপঢৌকনে, খানায়-খাদ্যে, বসনে-ভূষণে মেয়েই সেখানে প্রধান। জামাই চরিত্রটি ভীষণ ম্লান। আবার ফিরে যাওয়ার সময় জনক–জননীসহ স্বজন প্রতিবেশীর যে অশ্রু বিসর্জন, তা–ও মেয়ের জন্যই।

এই চিরায়ত ঐহিক আবহে সবারই প্রার্থনা মেয়ের সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় থাকুক, ধনে-জনে-মানে বেড়ে উঠুক মেয়ের সংসার। শাস্ত্রাচারের কঠিন নিয়মের বাইরে আবহমানকালের এই যে জীবনযাপন, তারই একটা ছাপ পড়েছে শারদীয় দুর্গাপূজার বিভিন্ন পর্বে। শাস্ত্রবিধিবদ্ধ না হলেও বাঙালি নারীরা যে সাদা জমিনের লাল পেড়ে শাড়ি পরেন পূজার বিভিন্ন দিনে, তার উৎস এই আবহমান জীবনচর্যা। দশমীর সাজে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হলুদ পেড়ে লাল শাড়ি কিংবা একদম লাল রঙা শাড়ি ব্যবহার মূলত লোকাচার নিগঢ়ে বাঁধা, শাস্ত্রাচারে নয়।

অনেকেই মনে করেন, লাল পাড় সাদা শাড়ি সধবা গৃহিণীর লক্ষণ। শারদীয়া দুর্গার বাঙালি রূপ—তিনি বিবাহিতা, গৃহিণী ও একান্নবর্তী পরিবারের কর্ত্রী। স্বামী-সন্তান-নন্দী-ভৃঙ্গী নিয়ে তাঁর ভরন্ত সংসার। তিনি মর্ত্যেও আসেন লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ ও শিবকে সঙ্গে নিয়ে। এই চিরন্তন একান্নবর্তী পরিবারের একচ্ছত্র কর্ত্রী ধরনটির সঙ্গে মেয়েরা নিজেদের মিলিয়ে নেয়। মিলিয়ে নেওয়ার এই ধারায় তার সঙ্গে জুড়ে যায় সাদা আর লালের প্রতীক। পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি এতে স্বস্তি পায়। মূলত পুরুষের চোখেই নারীকে দেখা হয়েছে চিরকাল। বাঙালি পুরুষ তাই দুর্গাকে মেয়ে হিসেবে দেখলেও সধবা হিসেবেই দেখতে চায়। সে কারণে পুরুষতন্ত্রও লাল আর সাদার এই ধারণাকে সমর্থন করে সমাজে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।

অনেক পরে, শহুরে বাঙালির ‘শিকড়মুখী’ চেতনার উন্মেষ ঘটলে ‘চিরায়ত’ বলে এই লাল–সাদাকে তারা গ্রহণ করে পার্বণ ও উৎসবের রং হিসেবে। এ জন্য শুধু পূজাতেই নয়, বৈশাখে নববর্ষের উৎসবেও বাঙালি নারী লাল পেড়ে সাদা শাড়িতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে আর পুরুষ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামায়। তবে এখন আরও কিছু উজ্জ্বল রং চোখে পড়ে বৈশাখী বসনে–ভূষণে।

পূজায় নতুন পোশাকের প্রচলন আদিকাল থেকেই ছিল। নতুন পোশাক ব্যবহারের এই প্রবণতাকে ট্রেন্ডি করে তোলা হয়েছে নাগরিক জীবনের অংশ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কলকাতা শহর। গ্রামীণ পরিসরে এখনো পূজার পর্বে পর্বে বিভিন্ন রঙের পোশাক পরার প্রচলন নেই।

শাস্ত্রে পাওয়া যায়, দুর্গাপূজায় সপ্তমী বিহিত পূজার শুরুতে মণ্ডপে নবপত্রিকা বা প্রচলিতভাবে পরিচিত ‘কলাবন’ স্থাপনের পর তাকে ‘পট্টবস্ত্র’ পরিধান করানো হয়। এই পট্টবস্ত্রের রং অতসী ফুলের মতো অর্থাৎ হলুদ। এ জন্য নবপত্রিকাকে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি অথবা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরানো হয়।

অন্যদিকে শৈল পুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী—দেবী দুর্গার নয়টি রূপ। এঁরাই হলেন নবদুর্গা। দেবীপক্ষের প্রথম দিন থেকে নবমী পর্যন্ত নবদুর্গার পূজা হয়। দেবী দুর্গার এই নয়টি রূপের অষ্টম রূপ ‘মহাগৌরী’। শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করে দেবী পার্বতীর গায়ের রং কালো হয়ে গিয়েছিল। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব দেবীকে দেখা দেন এবং শরীরের ক্লান্তি ও কালিমা দূর করতে তাঁকে গঙ্গাজলে স্নান করান। এর ফলে দেবী গৌর বর্ণা হয়ে ওঠেন। এই মহাগৌরীর বস্ত্র সাদা। হিন্দু শাস্ত্রে দেব-দেবীদের পরিধেয় বস্ত্রের এ রকম অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়।

পট্টবস্ত্রের কথায় একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, পট্টবস্ত্র আসলে কী, তা বোঝা খুবই কঠিন। এটি পাটের তৈরি বস্ত্র নয়। অনেকে কিংবা বেশির ভাগ লোকই পট্টবস্ত্রকে রেশম বস্ত্র বলে থাকেন। রেশমের বেশ কয়েকটি ভাগ আছে। যেমন মালবেরি সিল্ক, তসর, এরি সিল্ক, মুগা সিল্ক। মালবেরি সিল্কে তৈরি হয় গরদের শাড়ি। এর রং হলুদ। কিন্তু বস্ত্র তৈরির জন্য ডিগাম করলে এর রং বদলে যায়। তসরের রং ব্রাউন বা বাদামি। মুগা রেশমের রং ‘কাঁচা সোনার’ মতো অর্থাৎ হলুদ। নবপত্রিকাকে যে পট্টবস্ত্র পরানো হয়, তার রং হলুদ। তবে কি এটি মুগা রেশম থেকে তৈরি? গরদের আগেই মুগা সিল্ক আসার কথা। কারণ, মুগা প্রজাতিটি বন্য। গরদ সিল্ক তৈরি হয় মালবেরি সিল্কে। এটি গৃহপালিত প্রজাতি।

গরদই হোক আর মুগাই হোক, রেশম বা সিল্ক বস্ত্রমাত্রই মূল্যবান—তা আগেও ছিল, এখনো আছে। সে কারণে রেশম বস্ত্র বরাবরই অভিজাত মহলেই সীমাবদ্ধ ছিল। পূজায় গরদের কাপড় ধনিক শ্রেণিই ব্যবহার করে থাকে। সাধারণ্যে সুতিবস্ত্র। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, রেশম বস্ত্র পরে পূজা করা যায় না। এর কারণ এই বস্ত্র তৈরি হয় মূলত প্রাণিজ তন্তু থেকে। এ ছাড়া রেশম বস্ত্র জলে ধোয়া সম্ভব নয় বলে একবারের পর এটি অশুদ্ধ হয়ে যায়। আর পূজা অশুদ্ধ বস্ত্রে করা যায় না।

শাস্ত্রে যা–ই থাক, সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় জনরুচির হাত ধরে। পূজার সাজে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হলুদ পেড়ে লাল শাড়ি কিংবা একদম লাল রঙা শাড়ি অথবা রেশম বস্ত্রের ব্যবহার সময়ের চাহিদা। এ চাহিদা পূরণ হলে উৎসবের রং বাড়বে বৈ কমবে না।