বক্সা পাহাড়ে ব্যর্থ অভিযান

গভীর বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মসৃণ পাকা সড়ক
গভীর বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মসৃণ পাকা সড়ক

ইচ্ছা ছিল বক্সা পাহাড়ের চূড়ায় ২ হাজার ৭০০ ফুট উঁচুতে বক্সা ফোর্ট ঘুরে আসব। ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি বিপ্লবীদের আর স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার করে ওই দুর্গে রাখা হয়েছিল বলে শোনা যায়। ভারতের উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার শহর থেকে যাত্রা শুরু করেছি আমরা। ডুয়ার্সের দুর্দান্ত সৌন্দর্যকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ধাবমান মোটরবাইকে বক্সা পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছি আমরা দুজন। দুপাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে সরে যাচ্ছে চা–বাগান, তোরসা-ডিমা-নোনাই-কালকূট-ঘড়ঘড়িয়া-বালা নামের পাহাড়ি নদী, গভীর বন আর গভীর বনের বিচ্ছিন্ন জনপদ। সবুজ মায়ায় সেপ্টেম্বরের চিটচিটে গরমেও আমার চোখ জুড়িয়ে বরফ।

আলিপুরদুয়ার থেকে ২২ কি ২৩ কিলোমিটার দূরে বক্সা বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের গভীর বন। এই বন ছাড়িয়ে বক্সা পাহাড়। গভীর বনের মধ্য দিয়ে মসৃণ পাকা রাস্তা। ঘন বনের কোথায় হাতি আর কোথায় লেপার্ড ওত পেতে আছে, সেটা জানার উপায় নেই। বর্ষার পরপরই বন এত ঘন আর জটিল হয়েছে যে পাকা রাস্তা ছেড়ে ভেতরে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। প্রজনন ঋতু বলে সেপ্টেম্বর মাস বনে ‘অফ সিজন’। পায়ে চলার সব সরু পথ বন্ধ। তাই হাতি আর লেপার্ডের আক্রমণের ভয় তুচ্ছ করে নির্জন দুপুরে বনের নৈঃশব্দ্য ভেদ করে ঝিঁঝি আর নাম না–জানা পাখিদের ডাক শুনতে শুনতে মসৃণ পাকা রাস্তা ধরে বাইকে চেপে চলেছি বক্সা পাহাড়ের দিকে।

বক্সা বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প আর বক্সা পাহাড় দেখার জন্য ‘রাজাভাতখাওয়া’ নামে একটি জায়গায় থেমে টিকিট কাটতে হয়। আমরাও কাটলাম। জনশ্রুতি আছে, ১৮০০ সালের দিকে কোচবিহারের রাজা বর্তমানের রাজাভাতখাওয়া অঞ্চল থেকে ভুটানের রাজাকে বিতাড়ন করে ভাত খাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিছুদিন পরে ভুটানের রাজা এ অঞ্চল ত্যাগ করে কোচবিহার রাজের বন্ধুত্ব গ্রহণ করলে জঙ্গলঘেরা জনপদটিতে ভোজনের আয়োজন করা হয়। তখন থেকে জায়গাটির নাম রাজাভাতখাওয়া।

ভরদুপুরে ঝিঁঝির ডাক ঘুঘুর বিষণ্ন ডাকের চেয়েও নির্জন অনুভূতি দেয়। কখনো কখনো বনের ভেতর নির্জন রাস্তায় গা ছমছম করে ওঠে—ভূতের ভয়ে নয়, নীরবতায়। নৈঃশব্দ্য আর গাম্ভীর্য স্মরণ করিয়ে দেয়, অরণ্যের বিশালতা আর নিস্তব্ধতা অনুভব না করলে বনবিবির গুরুত্ব বোঝা সম্ভব নয়। প্রগাঢ় বনের অসীম শব্দহীনতায়, আলোছায়ার ভেলকিবাজিতে যারা বাঘের সামনে পড়েনি, তাদের কাছে দক্ষিণ রায় অথবা গাজী–কালু হাসির পাত্র ছাড়া কিচ্ছু নয়। গভীর বনের সীমাহীন নির্জনতায় হাঁসুয়া হাতে বন বিভাগের দু–একজন মানুষকে মাঝেমধ্যে দেখে আমাদের ভ্রম ভাঙে—আমরা শব্দ করে নিশ্বাস ফেলি। তারপর এগিয়ে চলি বক্সা পাহাড়ের দিকে মস্তিষ্কের গাঢ়তম প্রদেশে গভীর অরণ্যের দৃশ্যপট ধারণ করতে করতে।

পাথুরে জয়ন্তী নদীর ওপারে জয়ন্তী পাহাড়। তার ওপারে আছে ভুটান
পাথুরে জয়ন্তী নদীর ওপারে জয়ন্তী পাহাড়। তার ওপারে আছে ভুটান

হঠাৎ বন খানিক হালকা হতে শুরু করে। চোখের ওয়াইড লেন্সে ধরা পড়ে সেগুনগাছের বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি, সুপারিগাছের সারি আর ছোট ছোট লজের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা আমার দেখা প্রথম কালচে সবুজ পাহাড় বক্সা!

বক্সা পাহাড়ে যেতে সমতলের ঘন বন যেখানে গিয়ে মাথা ঠেকিয়েছে আর পাহাড় যেখান থেকে ঋজু হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, সেই ভূমিসন্ধির নাম সান্তালাবাড়ি। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। বন বিভাগের অফিস, নেপালিদের বাড়িঘর, রাস্তার দুদিকে দোকানপাট আর দর্শনার্থী—এই মিলিয়ে সান্তালাবাড়ি। বোঝা গেল, নেপালিদের বাড়িগুলোতে হোমস্টের ব্যবস্থা রয়েছে। বাড়ি পছন্দ করে নির্দিষ্ট ভাড়ার বিনিময়ে থাকা যায় এখানে।

সান্তালাবাড়ি পৌঁছালে শুরু হলো খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে হওয়া বৃষ্টি। আমরা দুজন একটি নেপালি দোকানে ঢুকে খেলাম সুস্বাদু নেপালি মোমো। টুকটাক কথা হলো দোকানের মালকিনের সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। বুঝলাম, এখানে আমিই একমাত্র বাংলাদেশি নই। ছোট দোকান। লোকজনের ভিড় তেমন নেই। তাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় বসে থাকতেও সমস্যা নেই। নেপালি শিশুরা ভারি সুন্দর দেখতে। দোকানে বসে বসে আমি আর সুমন্ত টুকটাক কথার ফাঁকে নেপালি শিশুদের দেখছি। বৃষ্টি থেমে প্রখর রোদ উঠলে আমরাও উঠে পড়লাম।

পাহাড়ের ওপর দিয়ে বক্সা থেকে ল্যাপচাখা যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের। বিশুদ্ধ অক্সিজেনে ভরপুর ফুসফুস নিয়ে ধীরেসুস্থে পাহাড়ে ওঠা শুরু হলো বয়স্ক আর এক পা খোঁড়া বাদামি রঙের একটি মাদি কুকুরকে সঙ্গী করে। এই পথে যারাই যায়, গ্রামের কুকুরগুলো নাকি তাদের সঙ্গী হয় যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার মতো!

দূর থেকে দেখা বক্সা পাহাড়। ছবি: লেখক
দূর থেকে দেখা বক্সা পাহাড়। ছবি: লেখক

পাথর ছড়ানো পাহাড়ি রাস্তা খুব খাড়া নয়। মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে উঠছি, সেটা শরীর জানান দিচ্ছে। হাঁটুর ওপর পুরো শরীরের ভর দ্বিগুণ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ঘন বনের নেশা আর বক্সা পাহাড়ের হাতছানি তখন আমাদের চোখেমুখে। রাস্তার বাঁ দিকে গভীর খাদের শেষ প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে নদী—প্রবহমান জলধারার শব্দ সেটাই জানান দিচ্ছে। আমার চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সেগুন, দেবদারুসহ কতশত নাম না—জানা প্রাচীন বৃক্ষ ঘোষণা করছে এই বনের প্রাচীনতা। এসব প্রাচীন গাছ আর নদী যদি জনপদের প্রাচীন গল্প শোনাতে পারত, পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো নতুন করে লিখতে হতো আবার। মধ্যদুপুরে বনে তারস্বরে ডেকে চলেছে ঝিঁঝি, ঘুঘু, আরও নাম না জানা পাখি আর পতঙ্গেরা। গুমোট ঘন বনের বীভৎস গরমে দরদর করে ঘামছি আমরা দুজন। আর এগোনো যাচ্ছে না। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, ঘামের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে শরীর জলশূন্য হয়ে যাবে এক্ষুনি। অগত্যা থামতে হলো। পড়ে থাকা একটি পুরোনো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দুই ঢোঁক জল পানের পর মনে হলো, বেঁচে আছি এখনো। প্রচণ্ড গরমে আর এগোনোর সাহস হলো না—গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে প্রাচীন গাছেদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো অপলক। এখানে প্রতিটি গাছগুলো গন্ধ আলাদা, পাহাড়ি বনের সৌরভ আলাদা, দূর থেকে অনুচ্চ শব্দে শোনা পাহাড়ি নদীর ধ্বনি আলাদা, ঘন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা আকাশের রংও আলাদা। অরণ্যের প্রগাঢ় নিস্তব্ধতায় প্রতিটি গন্ধ-ধ্বনি-সৌরভ-রংকে পৃথক করা যায় সহজে। সেই সৌরভ আর গন্ধ গায়ে মেখে অনুচ্চ পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসি আমি আর সুমন্ত। এভাবে আমার প্রথম অভিযানের অপমৃত্যু ঘটে!

খামাখা সময় নষ্ট না করে বাইক ছুটে চলে জয়ন্তী নদীর তীরে। পাহাড়ে বান ডাকলে মুহূর্তে সর্বনাশী হয়ে ওঠে পাহাড়ি-পাথুরে হাঁটুজলের নদী জয়ন্তী। তীরে দাঁড়িয়ে দেখা হলো দূরের কালচে জয়ন্তী পাহাড়। জানলাম, ওই পাহাড়ের পরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ভুটান।

সূর্য ডোবার আগে লেপার্ড আর হাতির ভয়ে দ্রুত ফিরতি পথ ধরা গেল। সুমন্ত জানাল, গাঢ় সবুজের প্রেক্ষাপটে লাল হেলমেট দেখে কয়েক দিন আগে একটি লেপার্ড গাছ থেকে টুক করে লাফ দিয়ে এক মোটরবাইক–আরোহীর মাথাটাই কেটে নিয়ে গেছে বনের ভেতরের এই একমাত্র রাস্তায়!

যেভাবে যাবেন

বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স যাওয়ার সবচেয়ে সহজ যাত্রাপথ হলো পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারতের ফুলবাড়ী বর্ডার পার হয়ে শিলিগুড়ি। সেখান থেকে ট্রেনে বা বাসে আলিপুরদুয়ার অথবা কোচবিহার শহর। সেখান থেকে বক্সা বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প ও বক্সা পাহাড়। অথবা বুড়িমারী সীমান্ত দিয়েও ডুয়ার্স যাওয়া যায় সহজে। তা ছাড়া কলকাতা থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার। সেখান থেকে বক্সা পাহাড়। বক্সা পাহাড় ও বন ভ্রমণের আদর্শ সময় শীতকাল। প্রাণীর প্রজনন মৌসুমের কারণে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস এখানে ভ্রমণ বন্ধ থাকে।