ব্যাটারি এনে দিল নোবেল

জন বি গুডএনাফ, এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম, আকিরা ইয়োশিনো
জন বি গুডএনাফ, এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম, আকিরা ইয়োশিনো

রসায়নে নোবেল মানে যেন ভারি খটমটে ব্যাপার। এবার যে তিন বিজ্ঞানী রসায়নে নোবেল পেলেন, তাঁদের গবেষণার বিষয়টি এখন সবার কাছেই পরিচিত। একেবারে নিত্যসঙ্গী। লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির উন্নয়নে গবেষণা করেছেন তাঁরা। মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, ট্যাব চলে এই লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারিতে। অনেক ল্যাপটপ কম্পিউটারও চলে এর শক্তিতে। আর এই ব্যাটারিই এবার এনে দিল নোবেল। লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি এবং এর কারিগরদের কথা থাকছে এখানে।

রসায়নে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অধ্যাপক জন বি গুডএনাফ, বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম এবং জাপানের মিজো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আকিরা ইয়োশিনো। গত কয়েক দশকে প্রযুক্তিবিশ্বে শক্তির বিপ্লব এনেছে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি। এই তিন বিজ্ঞানী এর পেছনের কারিগর। তাঁদেরকে অনায়াসে তিন শক্তিমানও বলা চলে। মুঠোফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপ থেকে শুরু পেসমেকারের মতো প্রযুক্তিপণ্য হাতের নাগালে এসেছে তাঁদের গবেষণার কল্যাণে। ছোটখাটো পণ্যই কেবল নয়, লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি দিয়ে গাড়ি এমনকি পুরো বাড়িও চলছে। দশ কথার এক কথা বলেছেন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি বনি কারপেনটিয়ার, ‘রসায়নও যে মানুষের জীবনযাপনে রূপান্তরিত হতে পারে, তার অনন্য উদাহরণ হলো লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি।’

যেভাবে এল লিথিয়াম–আয়ন

শক্তির উৎস হিসেবে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির আবির্ভাব ১৯৭০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রে তখন জ্বালানি তেলের ভীষণ সংকট। তেলের দাম বাড়ছিল রকেটগতিতে। উন্নত বিশ্বে যা হয়—অভাব থেকে উদ্ভাবন। সেটাই হয়েছিল মার্কিন মুলুকে। তেলের অভাবে শুরু হয় বিকল্প শক্তির সন্ধান। তখনই এগিয়ে আসেন এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম। উদ্ভাবন করেন নতুন এক ব্যাটারি, যার অ্যানোড তৈরি করা হয়েছিল লিথিয়াম দিয়ে। তবে সে ব্যাটারি বেশিক্ষণ ব্যবহার করলে বিস্ফোরিত হতো। আরও কিছু কারিগরি ত্রুটি ছিল ওটায়। তারপরও অ্যাসিডনির্ভর ব্যাটারির চেয়ে যা ছিল ঢের ভালো। টাইম ম্যাগাজিনকে হুইটিংগাম বলেছিলেন, ‘লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি সিসা ও অ্যাসিডেডর ব্যাটারির চেয়ে ১০ গুণ এবং নিকেল–ক্যাডমিয়াম ব্যাটারির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি শক্তি ধারণ করতে পারত। লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারিকে বেছে নেওয়ার পেছনে এই কারণগুলো বড় উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিল।’

১৯৮০ সালে হুইটিংগামের ভাবনার সলতেটি নতুন করে উসকে দেন জন বি গুডএনাফ। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারিতে বেশ উন্নতি আনেন এই বিজ্ঞানী। ১৯৮৫ সালে আবার আরেক প্রস্থ সংস্কার করেন জাপানের আকিরা ইয়োশিনো। এবার লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি ঝুঁকিমুক্ত হয়ে ওঠে। অতি ব্যবহারে বিস্ফোরিত হওয়ার শঙ্কা কমে যায় অনেকাংশে। ১৯৯১ সালে লিথিয়াম–আয়ন পুরোদস্তুর ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। বাজারে ব্যাটারিগুলো প্রথম আনে জাপানি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান সনি।

অজানা ভবিষ্যৎ

লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি যে দুনিয়া বদলে দেবে, তা অবশ্য শুরুতে আন্দাজ করতে পারেননি এর উদ্ভাবকেরা। গুডএনাফের বয়স এখন ৯৭। সবচেয়ে প্রবীণ নোবেলজয়ী এই বিজ্ঞানী দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘শুরুতে ভেবেছিলাম, এই ব্যাটারি মামুলি কিছু কাজেই হয়তো লাগবে। ধারণাও করিনি, ভবিষ্যতে তড়িৎ প্রকৌশলীরা কী করে বসবেন। সত্যিই কল্পনা করতে পারিনি, এই ব্যাটারি দিয়ে মুঠোফোন, ক্যামেরা বা অন্য কিছু চলবে।’

লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি
লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি

গুডএনাফের কল্পনার বাইরে চলে গেছে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারি। ভবিষ্যতে শক্তির উৎস হিসেবে এর ব্যবহার হবে বহুমাত্রিক। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তির আধারে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ক্যালিফোর্নিয়া সোলার অ্যান্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক বার্নাদেতে দেল চিয়ারো তো বলেই দিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতের নবায়নযোগ্য শক্তিতে লিথিয়াম–আয়ন প্রযুক্তি এমন ভূমিকা রাখবে, যা আমাদের
ধারণারও বাইরে।’

ভবিষ্যতের ব্যাটারি যে আরও চমকপ্রদ হবে, তা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, লিথিয়াম–আয়ন প্রযুক্তির কিছু সমস্যাও আছে। লিথিয়ামের চাহিদা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। লিথিয়াম মেলে তিব্বত ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চলের মাটির তলদেশে। এগুলো উত্তোলনের সময় দরকার হয় লাখ লাখ গ্যালন পানি। এসব নিয়ে নোংরা রাজনীতি কম চলছে না। এ ছাড়া লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির জন্য প্রয়োজনীয় কোবাল্টের মজুত যাচ্ছে কমে। কঙ্গোতে কোবাল্ট আহরণের ফলে পরিবেশ হুমকির মুখে, চলছে অমানবিক শিশুশ্রম। ব্যাটারিগুলো পুনরায় ব্যবহার বা ধ্বংস করাও ব্যয়বহুল। বিপজ্জনক
 তো বটেই।

নতুন শক্তি

এসবের সমাধানও অবশ্য আছে। সে পথ আবার দেখিয়েছেন ওই গুডএনাফ। ২০১৭ সালে লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির চেয়ে তিন গুণ শক্তিশালী ব্যাটারির ধারণা দিয়েছেন তিনি। নতুন এই ব্যাটারি নাকি দ্রুত চার্জড হবে, টিকবেও বেশি দিন। লিথিয়াম–আয়নের মতো এতে কোনো তরল উপাদান ব্যবহার করা হবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ব্যাটারি দাহ্য নয়, মানে আগুনে পুড়বে না। ব্যাটারিগুলো দামেও হবে সস্তা।

নতুন ব্যাটারি এসে পৃথিবী চালালেও মানুষ অবশ্য নিমকহারামি করবে না। ‘রাজা যায় রাজা আসে’। নতুন ব্যাটারি এলেও লিথিয়াম–আয়ন ব্যাটারির কথা মানুষ মনে রাখবে সব সময়। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে তিন শক্তিমান— গুডএনাফ, হুইটিংগাম এবং ইয়োশিনোকে। এই তিন শক্তিমান শক্তি প্রয়োগ করেননি, শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন, মানুষের জীবন হয়েছে সহজ। এ তো আর চাট্টিখানি কথা
নয়।