সহনশীলতা শেখা যায়

পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারেন। হোক না তা আপনার মতের সঙ্গে অমিল। ছবি: কবির হোসেন
পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারেন। হোক না তা আপনার মতের সঙ্গে অমিল। ছবি: কবির হোসেন
>

এই সময়ে মনে হচ্ছে আমাদের সমাজে সহনশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে, আমাদের সামাজিক আচরণে সহনশীলতা নেই। কেউ জন্ম থেকে সহনশীল, কেউ সাংস্কৃতিক সমুন্নতির কারণে সহনশীল। সহনশীলতা একটি গুণ, যা চরিত্রগতভাবে মানুষ অর্জন করতে পারে। আবার শিক্ষার মাধ্যমেও আয়ত্ত করতে পারে। সহনশীলতার জন্য চাই অন্যের মত ও আচরণকে সহ্য করা। অন্যের অধিকার মেনে নেওয়া, মনকে উদার করা। লিখেছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

আমাদের নাগরিক সমাজের এই সময়ের বাস্তবতায় সহনশীলতা একটি তাজা শব্দ। চায়ের টেবিলে, বিকেলের আড্ডায়, মিডিয়ার পাতায়-পর্দায় অসংখ্যবার শব্দটি উচ্চারিত হয়, তবে এর সঙ্গে নেতির সংযোগটিই বেশি। বলা হয়, আমাদের সমাজে সহনশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে, আমাদের সামাজিক আচরণে সহনশীলতা নেই। আমাদের রাজনীতি থেকে সহনশীলতা বিদায় নিয়েছে। এক টেলিভিশন কথা–প্রদর্শনীতে দেখলাম দুই দলের দুই রাজনীতিবিদ বিরাট তর্ক জুড়ে দিয়েছেন, পারলে পরস্পরকে আঘাতই করে বসেন। তাঁদের দুজনেরই বক্তব্য, আমাদের রাজনীতিতে সহনশীলতার অভাব এবং সহনশীলতাই পারে সৌহার্দ্য সৃষ্টি করতে। তাঁদের দেখে মনে হলো, সহনশীলতা বিষয়টিই তাঁদের কাছে অধরা রয়ে গেছে।

তবে সহনশীলতা যে নেই, তা কিন্তু নয়। সহনশীলতা আছে এবং ভালোভাবেই আছে। সমস্যা হয়, আমাদের সমাজে সহনশীল যাঁরা, তাঁরা দুর্বল এবং এ কারণে যাঁরা শক্তিমান, তাঁরা এটিকে দুর্বলতা ভাবেন। আমাদের মায়েরা সহনশীল—তাঁরা সহনশীল না হলে পরিবারে ভাঙন ধরত—আমাদের কৃষকেরা সহনশীল, বন্যায় তাঁদের ফসল ভেসে গেলেও, খরায় শুকিয়ে গেলেও তাঁরা সহ্য করে নেন, পরের মৌসুমের জন্য আশায় বুক বাঁধেন; আমাদের শ্রমিকেরা সহনশীল, তাঁরা মালিকের শোষণ-অত্যাচার সহ্য করে কাজ করে যান। সহনশীলতা বরং নেই যাঁরা বড় চাকরি করেন অথবা যাঁরা সম্পদের পাহাড় গড়েন অথবা ক্ষমতার গদিতে বসেন—তাঁদের বিবেচনায় সহনশীলতা তাঁদের গুরুত্ব কমিয়ে দেবে, মানুষের কাছে তাঁদের দুর্বল প্রমাণ করবে, যেমন করবে বিনয় অথবা শিষ্টাচার।

আমাদের শিক্ষিতরাও অনেকেই সহনশীলতার চর্চা থেকে দূরে থাকেন। অথচ হেলেন কেলার বলতেন, শিক্ষার সর্বোচ্চ ফল হচ্ছে সহনশীলতা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছেলেকে তাঁর মতপ্রকাশের ‘অপরাধে’ পিটিয়ে মেরে ফেলল কেতাবি অর্থে কিছু মেধাবী ছেলে। সহনশীলতার অভাব হলে এ রকম বীভৎসতা যেকোনো সময়ে, যেকোনো জায়গায় হতে পারে। মাত্রাটা কম–বেশি হবে মাত্র।

যেকোনো জায়গা, মানে রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিসরে, প্রতিষ্ঠানে, পরিবারে। এমনকি দুই বন্ধুর মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরতে পারে, যদি একজন অন্যজনের প্রতি সহনশীল আচরণ করতে না পারে। সহনশীলতা একটি গুণ, যা চরিত্রগতভাবে মানুষ অর্জন করতে পারে। আবার শিক্ষার মাধ্যমেও আয়ত্ত করতে পারে। কেউ জন্ম থেকে সহনশীল, কেউ সাংস্কৃতিক সমুন্নতির কারণে সহনশীল। স্কুলে আমার এক শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে কোনো কিছুতেই বিরক্ত হতে দেখতাম না। আমাদের সব অপরাধ (ক্লাসে গন্ডগোল করা, ফাঁকি মারা) তিনি সহ্য করতেন, তাঁর মুখের হাসিটি সব সময় অমলিন থাকত। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন খুব সুখী মানুষ। স্যারের এক ছেলের সঙ্গে একদিন দেখা হলো দেশের বাইরে। দেখলাম, তিনিও সহনশীল মানুষ। তিনি জানালেন, তাঁর বাবা তাঁকে শিখিয়েছেন ধৈর্যহারা হলে ক্ষতি যা হওয়ার তাঁরই হবে, সহ্য করার ক্ষমতা না থাকলে জীবনে দ্বন্দ্ব–বিবাদ লেগেই থাকবে। অথচ কী সহজে মানুষ অসহ্য হয়ে পড়ে আর অকারণে নিজের ওপর চাপ বাড়ায়।

রাষ্ট্রের কাঠামোয় সহনশীলতা প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থে। গণতন্ত্র মানেই পরমতসহিষ্ণুতা, নিজের বা নিজ দলের বাইরের মানুষের অধিকার মেনে নেওয়া। প্রতিষ্ঠানে সহনশীলতা প্রয়োজন শুধু যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে বা বজায় রাখতে তা নয়, বরং সবার কর্মক্ষমতা বাড়াতেও। সহনশীল পরিবেশ মানুষের কাজের স্পৃহা ও ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। সবাই একে অপরকে মূল্য দিতে, সম্মান করতে শেখে, তাতে লাভ হয় প্রতিষ্ঠানের। সহনশীল মানুষ অন্যের শ্রদ্ধা পায়, কিছু না হলেও ঝগড়াঝাঁটির বাইরে থেকে নিজের মনের শান্তি ধরে রাখতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু সহনশীলতার চর্চা নয়, এটিকে শিক্ষার একটা উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দেয়ালে খোদাই করে লেখা একটি বাক্য আমাকে চমকে দিয়েছিল, ‘যে সহনশীল নয়, এই ভবনের দরজা তার জন্য উন্মুক্ত নয়’—কথাটির দ্যোতনা অনেক। জ্ঞানী মানুষকে সবার মতকে মূল্য দিতে হয়, না হলে তাঁর জ্ঞান পূর্ণ হয় না। যে যত জ্ঞানী, তাঁর ভেতরটা তত বড়; তাতে একটা মতের সংকুলান হয়েও প্রচুর জায়গা থেকে যায়।

একে অপরের পাশে থেকে সহনশীলতার চর্চা করুন, মন উদার রাখুন। মডেল: তাহসিন, রিমি, রোজ ও জুবায়ের
একে অপরের পাশে থেকে সহনশীলতার চর্চা করুন, মন উদার রাখুন। মডেল: তাহসিন, রিমি, রোজ ও জুবায়ের

পরিবারে সহনশীলতা অত্যন্ত জরুরি। বাঙালি সমাজে পরিবারের কর্তারা একসময় আধিপত্যবাদী ছিলেন, এখনো অনেক পরিবারে আছেন। যদিও নারী শিক্ষা ও নারীদের স্ব-ক্ষমতায়ন অবস্থাটা পাল্টাচ্ছে। কিন্তু এখনো পুরুষ কর্তৃত্ব করতে চায়। যত দিন পরিবারের সংজ্ঞায় কর্তৃত্ব কথাটি থাকবে, তত দিন পরিবারগুলো অসম্পূর্ণ থাকবে, তাদের ভেতর ভারসাম্যের অভাব থাকবে। পরিপূর্ণতার দিকে একটি পরিবারের যাত্রা হতে পারে সহনশীলতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। সহনশীলতা শ্রদ্ধা শেখায়, পরস্পরকে একান্ত পরিসরে সম্মান করতে শেখায় এবং পরস্পর নির্ভরতাকে একটি সুন্দর মাত্রা দেয়। এর অভাব হলে সম্পূর্ণগুলোতে টান পড়ে, ঘর্ষণ লাগে।

সহনশীল হওয়াটা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন অনেক কারণে। প্রথম তো মানুষের সম্পর্কগুলো সুন্দর রাখার জন্য মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য অবস্থা এবং ভালোবাসার পরিবেশ তৈরির জন্য। কিন্তু এরপর যে প্রয়োজন, তা প্রায়োগিকও বটে। সোজা কথায়, এতে ক্ষতির চেয়ে লাভ হয় অনেক বেশি। সহনশীলতার অভাব মানুষকে তিক্ত করে তোলে, তার ওপর মানুষের আস্থা চলে যায়। পরিবারের বা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডিতে এ রকম মানুষকে অন্যরা এড়িয়ে চলে।

মানুষকে সহনশীল হতে দেয় না ক্ষমতা এবং ক্ষমতার হাত ধরে আসা প্রতিপত্তি, অর্থ, অহমবোধ। অসহিষ্ণু মানুষ নিজের ক্ষমতাকে রক্ষাকবচ ভাবতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি তার রক্ষণদেয়ালে ফাটল ধরায়। জ্ঞানের সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে, কিন্তু ক্ষমতা যদি সৃষ্টিশীল হয়, তাহলে জ্ঞানের বিষয়টিও নতুন মাত্রা পায়। সহনশীলতা মানুষকে সৃষ্টিশীলও করে।

সহনশীলতা শেখা যায়। এর জন্য প্রয়োজন মনটাকে উদার করা। অন্যকে, অন্যের মত ও আচরণকে সহ্য করা, অন্যের অধিকার মেনে নেওয়া। এগুলো খুব যে কঠিন তা নয়, এটি করা গেলে কত বন্ধুত্ব, কত দাম্পত্য, কত পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্ব মূল্যবান হয়, পরিপূর্ণ হয়, তার কোনো ধারণা আমরা করতে পারব না। আর রাষ্ট্রে সহনশীলতা থাকলে রাষ্ট্রটি গরিব হলেও বসবাসের জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে, গণতন্ত্রের জন্য কাঙ্ক্ষিত রূপ হয়ে দাঁড়ায়।